Monday 18 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাতিল টায়ার: বর্জ্য থেকে সম্পদে রূপান্তরে বাংলাদেশে এক নতুন দিগন্ত

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)
১৮ আগস্ট ২০২৫ ১৬:৫৯

প্রতি বছর বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ গাড়ির পুরাতন টায়ার বাতিল হয়, যা পরিবেশের জন্য এক নীরব ঘাতক। এই টায়ারগুলি পচে না, পুড়িয়ে ফেললে বিষাক্ত ধোঁয়ায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কিন্তু এই বর্জ্যকে শুধু অভিশাপ হিসেবে না দেখে, যদি একটি অর্থনৈতিক সুযোগ হিসেবে দেখা যায়, তাহলে পরিবেশ রক্ষা এবং আর্থিক সমৃদ্ধি উভয়ই অর্জন করা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী ব্যবস্থার মাধ্যমে এই পুরাতন টায়ারকে বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য পণ্যে রূপান্তর করা যায়, যা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করতে পারে।

বাংলাদেশে বাতিল টায়ারের বর্তমান অবস্থা: বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে পুনর্ব্যবহার

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে বাংলাদেশে বাতিল টায়ার ব্যবস্থাপনার চিত্রটি বেশ হতাশাজনক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই টায়ারগুলি খোলা জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয়, যা মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করে এবং অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়ায়। কিছু ক্ষেত্রে এগুলোকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুড়িয়ে ফেলা হয়, যা মারাত্মক বায়ু দূষণের কারণ হয়। সীমিত পরিসরে কিছু ব্যক্তি বা ছোট প্রতিষ্ঠান এই টায়ারগুলিকে কিছু নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহার করে থাকেন, যেমন:

* রাস্তার বেড়া বা বিভাজক: নির্মাণাধীন স্থানে বা গ্রামীণ সড়কে অস্থায়ী বেড়া হিসেবে টায়ার ব্যবহার করা হয়।

* কৃষি কাজ: সেচ পাম্প বা অন্যান্য যন্ত্রপাতির ভিত্তি হিসেবে টায়ার ব্যবহার করা হয়।

* শিশুদের খেলার সরঞ্জাম: দোলনা বা ছোটখাটো খেলার উপকরণ তৈরিতে টায়ার ব্যবহার হয়।

* সিমেন্ট কারখানায় সীমিত ব্যবহার: কিছু সিমেন্ট কারখানা বর্জ্য টায়ারকে জ্বালানি হিসেবে সীমিত আকারে ব্যবহার করে, তবে তা এখনও ব্যাপক আকার ধারণ করেনি।

* ছোট পরিসরে ক্রাফট তৈরি: শৌখিনতার বশে টায়ার থেকে ফুলদানি, বসার টুল বা অন্যান্য সজ্জাসামগ্রী তৈরি করা হয়।

এই ব্যবহারগুলি অত্যন্ত সীমিত এবং বাতিল হওয়া টায়ারের একটি ক্ষুদ্র অংশকে মাত্র ব্যবহার করে। বেশিরভাগ টায়ারই অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে, যা পরিবেশের উপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে। এই সীমিত ব্যবহারের প্রধান কারণ হলো, প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাব, কার্যকর সংগ্রহ ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এবং পুনর্ব্যবহার শিল্পের প্রতি সরকারি ও বেসরকারি খাতের দুর্বল মনোযোগ।

বাতিল টায়ারকে সম্পদে রূপান্তরের প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়া এবং প্রয়োজনীয়তা

বাতিল টায়ারকে কার্যকরভাবে ব্যবহারযোগ্য সম্পদে রূপান্তরিত করতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত সহায়তা অপরিহার্য। এই প্রযুক্তিগুলি কেবল বর্জ্য নিষ্পত্তিতেই নয়, বরং নতুন শিল্প তৈরি এবং অর্থনৈতিক মূল্য সংযোজনেও সহায়ক।

১. পায়রোলাইসিস (Pyrolysis): এটি একটি অত্যন্ত কার্যকর প্রক্রিয়া যেখানে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে উচ্চ তাপমাত্রায় টায়ারকে উত্তপ্ত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় টায়ার ভেঙে তিনটি প্রধান উপাদান তৈরি হয় …

* টায়ার তেল (Tyre Pyrolysis Oil – TPO): এটি একটি শিল্প জ্বালানি যা ফার্নেস তেল বা ডিজেলের বিকল্প হিসেবে বয়লার, জেনারেটর বা অন্যান্য শিল্প যন্ত্রপাতিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং শিল্প কারখানায় জ্বালানি হিসেবে এর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হতে পারে।

* কার্বন ব্ল্যাক (Carbon Black): এটি টায়ারের একটি মূল উপাদান এবং রং, কালি, প্লাস্টিক, রাবার পণ্য (যেমন নতুন টায়ার, জুতার সোল), এবং এমনকি ব্যাটারির ইলেক্ট্রোড তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের প্লাস্টিক ও রাবার শিল্পে এর বিশাল চাহিদা রয়েছে।

* স্টিল তার (Steel Wire): টায়ারের মধ্যে থাকা ইস্পাতের তারগুলি সংগ্রহ করে পুনর্ব্যবহার করা যায়, যা ইস্পাত শিল্পের জন্য মূল্যবান কাঁচামাল।

২. ক্রায়োজেনিক গ্রাইন্ডিং (Cryogenic Grinding): এই অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে টায়ারকে তরল নাইট্রোজেনের সাহায্যে অত্যন্ত শীতল করা হয়, যা এটিকে ভঙ্গুর করে তোলে। এরপর এটিকে সূক্ষ্ম কণায় পিষে ক্রাম রাবার (Crumb Rubber) তৈরি করা হয়।

* ক্রাম রাবার: এটি খেলাধুলার মাঠ (যেমন কৃত্রিম ফুটবল বা ক্রিকেট পিচ), রাস্তার পিচ (রাবারাইজড অ্যাসফল্ট), ছাদের ওয়াটারপ্রুফিং, জুতার সোল, ফ্লোর ম্যাট এবং অন্যান্য রাবার পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে উন্নত রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং আধুনিক ক্রীড়া অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে ক্রাম রাবারের ব্যবহার ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। রাবার মিশ্রিত পিচ রাস্তা দীর্ঘস্থায়ী হয়, শব্দ দূষণ কমায় এবং ভাঙন রোধে সহায়ক।

৩. পুনর্নির্মাণ (Re-treading): এটি সরাসরি নতুন পণ্য তৈরি না করলেও, টায়ারের জীবনকাল বাড়িয়ে বর্জ্য উৎপাদন কমায়। এক্ষেত্রে পুরনো টায়ারের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ বাদ দিয়ে নতুন রাবার যুক্ত করে এটিকে পুনরায় ব্যবহারোপযোগী করা হয়। বিশেষ করে বাস, ট্রাক এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক যানবাহনের টায়ারের জন্য এটি একটি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশ-বান্ধব সমাধান।

৪. পুনর্ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন (Recycled Product Manufacturing): টায়ারকে টুকরো করে বিভিন্ন আকার দিয়ে সরাসরি ব্যবহারযোগ্য পণ্য তৈরি করা যায়, যেমন:

* রাস্তার পাশে স্থাপন করা নিরাপত্তা বাধা (Road Barriers)।
* শিশুদের খেলার মাঠের মেঝে (Playground Surfaces)।
* ল্যান্ডস্কেপিং এবং বাগান সজ্জার উপাদান।
* বিভিন্ন ধরনের ফ্লোর ম্যাট ও ডোর ম্যাট।

এই প্রযুক্তিগুলির জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগ বেশি হলেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি অত্যন্ত লাভজনক হতে পারে। বাংলাদেশে এই প্রযুক্তিগুলি আমদানির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে কাস্টমাইজ করা প্রয়োজন, যাতে তা দেশের জলবায়ু ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

ই-কমার্সের ভূমিকা: সংগ্রহ, বাজারজাতকরণ এবং সম্প্রসারণ

বাতিল টায়ার সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাত পণ্য বাজারজাতকরণ এবং সামগ্রিক শিল্প সম্প্রসারণে ই-কমার্স একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে:

১. সহজ সংগ্রহ ব্যবস্থা: ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলি বাতিল টায়ার সংগ্রহের জন্য একটি কেন্দ্রীভূত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে। ব্যক্তি বা গ্যারেজ মালিকরা তাদের পুরাতন টায়ার বিক্রির জন্য অনলাইনে তালিকাভুক্ত করতে পারেন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ ইউনিটগুলি সরাসরি তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারে। এতে সংগ্রহের খরচ কমবে এবং একটি সুসংগঠিত সরবরাহ চেইন তৈরি হবে।

২. পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের বাজারজাতকরণ: টায়ার থেকে উৎপাদিত পণ্য, যেমন টায়ার তেল, কার্বন ব্ল্যাক, ক্রাম রাবার, ফ্লোর ম্যাট বা অন্যান্য ক্রাফট পণ্য ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে সরাসরি ভোক্তা বা শিল্প ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা যেতে পারে। এটি ঐতিহ্যবাহী বিপণন পদ্ধতির চেয়ে দ্রুত এবং বৃহত্তর পরিসরে বাজার তৈরি করতে সহায়তা করবে।

৩. স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা: ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে পণ্যের মূল্য এবং গুণগত মান যাচাই করা সহজ হবে, যা ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্য স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করবে।

৪. ছোট উদ্যোক্তাদের সুযোগ: ছোট আকারের পুনর্ব্যবহার ইউনিট বা কুটির শিল্পগুলি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তাদের উৎপাদিত পণ্য সহজেই বৃহত্তর বাজারে পৌঁছে দিতে পারবে, যা তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে সহায়ক হবে।

৫. আন্তর্জাতিক বাজার সংযোগ: আন্তর্জাতিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বিদেশী ক্রেতাদের কাছে রপ্তানি করা সম্ভব হবে, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হবে।

৬. সচেতনতা বৃদ্ধি: ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলি বাতিল টায়ারের পুনর্ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখতে পারে, যা এই শিল্পের সামগ্রিক বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা: অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং রপ্তানি আয়

বাতিল টায়ার পুনর্ব্যবহার শিল্পের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ব্যাপক। এটি কেবল পরিবেশগত সুবিধা দেয় না, বরং কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টন পুরনো টায়ার উৎপন্ন হয় বলে অনুমান করা হয়। এই বিশাল পরিমাণ টায়ার থেকে উৎপাদিত পণ্যের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

* রাস্তার নির্মাণ: দেশের রাস্তাঘাটের বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে, এবং প্রতি বছর নতুন রাস্তা নির্মাণ ও পুরনো রাস্তা সংস্কারের জন্য বিপুল পরিমাণ পিচের প্রয়োজন হয়। যদি এর একটি অংশও রাবারাইজড অ্যাসফল্ট দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়, তবে তা কেবল রাস্তার স্থায়িত্বই বাড়াবে না, বরং পরিবেশগতভাবেও টেকসই হবে। ক্রাম রাবারের অভ্যন্তরীণ বাজার বছরে কয়েক হাজার টন হতে পারে।

* শিল্প জ্বালানি: বাংলাদেশের শিল্প কারখানায় (যেমন পোশাক শিল্প, টেক্সটাইল, ইটভাটা) জ্বালানি হিসেবে ফার্নেস তেল ও ডিজেলের বিশাল চাহিদা রয়েছে। টায়ার তেল এই জ্বালানিগুলির একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারে, যা প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার আমদানি নির্ভরতা কমাতে পারে।

* প্লাস্টিক ও রাবার শিল্প: বাংলাদেশের উদীয়মান প্লাস্টিক ও রাবার শিল্প কার্বন ব্ল্যাক এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য রাবারের একটি বড় ভোক্তা। এই শিল্পগুলির জন্য স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল সরবরাহ করে আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব।

* নির্মাণ শিল্প: ক্রাম রাবার এবং অন্যান্য টায়ার বর্জ্য থেকে তৈরি পণ্য নির্মাণ শিল্পে (যেমন সাউন্ডপ্রুফিং মেটেরিয়ালস, ফ্লোরিং) ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি বাংলাদেশের উৎপাদিত বাতিল টায়ারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ (উদাহরণস্বরূপ, ৫০%) সফলভাবে প্রক্রিয়াজাত করা যায়, তবে তা অভ্যন্তরীণ বাজারেই প্রায় ৫০০-১০০০ কোটি টাকার পণ্য সরবরাহ করতে পারে।

রপ্তানি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন

অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি, পুরনো টায়ার থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।

* টায়ার তেল: আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের চাহিদা সর্বদা বেশি। পরিশোধিত টায়ার তেল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের দেশগুলিতে রপ্তানি করা যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা টায়ার তেলের বাজারকে আরও প্রসারিত করছে।

* কার্বন ব্ল্যাক: বিশ্বব্যাপী কার্বন ব্ল্যাকের বাজার অত্যন্ত বড়, বিশেষ করে টায়ার, প্লাস্টিক ও রাবার পণ্য উৎপাদনকারী দেশগুলিতে। চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, এবং ইউরোপের দেশগুলিতে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। উচ্চমানের কার্বন ব্ল্বনরপ্তানি করে বাংলাদেশ বছরে কয়েক মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে।

* ক্রাম রাবার: যেসব দেশে উন্নত অবকাঠামো এবং খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধা তৈরির প্রবণতা বেশি, সেখানে ক্রাম রাবারের চাহিদা ব্যাপক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে এটি রপ্তানি করা যেতে পারে।

* স্টিল তার: পুনর্ব্যবহারযোগ্য স্টিল তারগুলি আন্তর্জাতিক ইস্পাত বাজারে মূল্যবান কাঁচামাল হিসেবে রপ্তানি করা যেতে পারে।

আনুমানিক হিসাবে, যদি বাংলাদেশের বাতিল টায়ারের একটি বড় অংশ (যেমন ৭০-৮০%) সফলভাবে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানিযোগ্য পণ্যে রূপান্তরিত করা যায়, তাহলে বছরে ৫০ মিলিয়ন থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলার বা তারও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বিশ্ববাজারে এই পণ্যগুলির ক্রমবর্ধমান চাহিদা বাংলাদেশের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। এটি দেশের রপ্তানি খাতকে বৈচিত্র্যময় করবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াবে।

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধানের পথ

এই সম্ভাবনাময় শিল্পের বিকাশে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা মোকাবেলা করা অপরিহার্য:

* প্রাথমিক বিনিয়োগ: পায়রোলাইসিস বা ক্রায়োজেনিক গ্রাইন্ডিং প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য উচ্চ প্রাথমিক বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সহজ শর্তে ঋণ এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা জরুরি।

* প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা: এই প্রক্রিয়াগুলি পরিচালনার জন্য বিশেষ প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব রয়েছে। কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা যেতে পারে।

* সংগ্রহ ও লজিস্টিকস: সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা বাতিল টায়ার সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্টে পরিবহনের জন্য একটি সুসংগঠিত এবং দক্ষ লজিস্টিকস সিস্টেম প্রয়োজন। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং স্থানীয় বর্জ্য সংগ্রহকারীদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এটি উন্নত করা যেতে পারে।

* পরিবেশগত ছাড়পত্র ও মনিটরিং: প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় যাতে পরিবেশ দূষণ না হয়, তা নিশ্চিত করতে কঠোর পরিবেশগত নিয়মাবলী এবং নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন। দূষণমুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

* বাজার উন্নয়ন ও গুণগত মান: অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক উভয় বাজারেই এই পণ্যগুলির জন্য একটি স্থিতিশীল চাহিদা তৈরি করা এবং পণ্যের গুণগত মান আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী বজায় রাখা জরুরি।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

বাতিল টায়ারকে সম্পদে রূপান্তর করা কেবল পরিবেশ সুরক্ষার একটি উপায় নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন অর্থনৈতিক সুযোগও তৈরি করতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তিগত সহায়তা, ই-কমার্সের ব্যবহার এবং সমন্বিত সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে এই খাতটি দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এটি পরিবেশগত সচেতনতা বৃদ্ধি, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি টেকসই ও সবুজ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার এই দূরদর্শী পদক্ষেপ বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতার পথ সুগম করবে এবং বিশ্ব দরবারে একটি পরিবেশ-সচেতন জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

সারাবাংলা/এনএল/এএসজি

বাতিল টায়ার মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর