Sunday 24 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আরাল সাগর: এক হারানো নীলিমার গল্প

ফারহানা নীলা
২৪ আগস্ট ২০২৫ ১৭:২৭

মহাদেশের মানচিত্রে একসময় বিশাল নীলাভ আভায় জ্বলজ্বল করত আরাল সাগর। মধ্য এশিয়ার কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তানের সীমান্তে অবস্থিত এই সাগর ছিল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম জলাধার। স্থানীয় ভাষায় যার অর্থই ‘দ্বীপের সাগর’— কারণ অসংখ্য দ্বীপকে বুকে ধারণ করেছিল সে। কিন্তু আজ আরাল সাগরকে বলা হয় ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রতীক’।

এক সমৃদ্ধ অতীত

ষাটের দশক পর্যন্ত আরাল সাগর ছিল জীবনের উচ্ছ্বাসে ভরা। এখানে মাছ ধরা, নৌপরিবহন, আর জলভিত্তিক বাণিজ্য ঘিরে হাজার হাজার মানুষের জীবিকা গড়ে উঠেছিল। নৌবন্দর ঘেঁষা শহরগুলো ছিল প্রাণচঞ্চল, বাজারে ছিল মাছের অফুরন্ত সরবরাহ। একে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ শিল্পকারখানা।

বিজ্ঞাপন

মানুষের হস্তক্ষেপ ও মৃত্যুঘণ্টা

কিন্তু সত্তরের দশক থেকে শুরু হলো সাগরের করুণ পতন। সোভিয়েত শাসনামলে তুলা চাষ বাড়ানোর জন্য আরাল সাগরে প্রবাহিত দুটি প্রধান নদী—আমু দারিয়া ও সির দারিয়ার পানি কৃষিজমিতে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিশাল এই সেচ প্রকল্পই হয়ে ওঠে আরালের মৃত্যুঘণ্টা। পানি প্রবাহ কমতে কমতে সাগর শুকাতে শুরু করল। কয়েক দশকেই সাগরের আয়তন চারভাগের তিনভাগ কমে যায়।

শুকিয়ে যাওয়া সমুদ্রতল

যে জায়গায় একসময় ঢেউ খেলত, আজ সেখানে লবণের মরুভূমি। উন্মুক্ত সমুদ্রতলে পড়ে আছে মরিচা ধরা নৌকা, যা এখন মৃতভূমির নিঃশব্দ সাক্ষী। বাতাসে ভেসে বেড়ায় লবণ আর বিষাক্ত ধূলিকণা, যা দূষণ ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। স্থানীয় মানুষ ভুগছে শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার ও নানা রোগে। কৃষিক্ষেত্রও লবণে ভরে গেছে, উর্বরতা হারিয়েছে জমি।

হারানো জীবিকা, হারানো শহর

যে শহরগুলো একসময় বন্দরের কোলাহলে মুখর ছিল, আজ সেগুলো প্রায় জনশূন্য। মাছ ধরার নৌকাগুলো পরিণত হয়েছে মরুভূমির স্মৃতিস্তম্ভে। হাজার হাজার মানুষ বাধ্য হয়েছে পেশা বদলাতে, অনেকে ছেড়ে গেছে জন্মভিটে।

নতুন আশার আলো

তবে সবকিছুই শুধু হতাশার গল্প নয়। আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় কাজাখস্তান ‘কোক-আরাল বাঁধ’ তৈরি করেছে, যাতে সাগরের উত্তরাংশে আবারও পানি ফিরে আসে। সেখানে কিছু মাছও ফিরেছে, স্থানীয় জেলেরা আবারও স্বপ্ন দেখছে। যদিও দক্ষিণ আরাল সাগর এখন প্রায় হারিয়েই গেছে, তবু উত্তর অংশের পুনর্জাগরণ দেখাচ্ছে, প্রকৃতিকে সময় ও যত্ন দিলে সে আবারও শ্বাস নিতে পারে।

শিক্ষার জায়গা

আরাল সাগরের গল্প শুধু এক সাগরের নয়; এটি মানুষের লোভ, পরিকল্পনার ভুল এবং পরিবেশ উপেক্ষার পরিণতি। এটি আমাদের শেখায়—প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে নয়, বরং তাকে সম্মান করেই বাঁচতে হয়।

আজ আরাল সাগর নেই বললেই চলে, কিন্তু তার শুকনো বুকে দাঁড়িয়ে থাকা মরিচা ধরা নৌকাগুলো যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সতর্ক করে দেয়: যদি আমরা প্রকৃতিকে ভালো না বাসি, একদিন সে-ও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।

সারাবাংলা/এফএন/এএসজি

আরাল সাগর