Monday 25 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

টাইটানিকের মেন্যুর দাম কেন এত বেশি?

ফারহানা নীলা
২৫ আগস্ট ২০২৫ ১৮:৪৫

মানুষের স্মৃতিতে টাইটানিক শুধু এক দুর্ঘটনার নাম নয়; এটি এক যুগের আভিজাত্য, বিলাসিতা ও স্বপ্নভঙ্গের প্রতীক। ১৯১২ সালের এপ্রিল মাসে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্কগামী এই জাহাজে চড়েছিলেন বিশ্বের ধনী-গরিব নানা শ্রেণির যাত্রী। ডুবন্ত জাহাজের অশ্রুসিক্ত ইতিহাসের বাইরে আজও আলোচনায় আছে এর বিলাসবহুল খাবারের মেন্যু।

ফার্স্ট ক্লাসের বিলাসী ভোজ _

প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জন্য টাইটানিক ছিল ভাসমান প্রাসাদ। তাদের মেন্যুতে ছিল ১০ থেকে ১৩ পদবিশিষ্ট একেকটি ডিনার। ইউরোপের রাজপ্রাসাদের মতোই সেখানে পরিবেশিত হতো অদ্ভুত সব খাবার।

স্টার্টার: ঝিনুক, ক্যানাপে, স্যুপ।

বিজ্ঞাপন

প্রধান খাবার: রোস্টেড স্কোয়াব (কবুতরের মাংস), ফিলে মিনিয়ন, ল্যাম্ব উইথ মিন্ট সস, ডাক কনফি।

সাইড: আলুর নানা পদ, সবজির কারি, সালাদ।

ডেজার্ট: ওয়ালডর্ফ পুডিং, চার্ট্রিউজ জেলি, আইসক্রিম, ফলমূল।
সাথে থাকত দামী ওয়াইন ও শ্যাম্পেন।

সেকেন্ড ও থার্ড ক্লাসের মেন্যু _

দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রীদের জন্য মেন্যু ছিল তুলনামূলক সাধারণ, তবে তখনকার মানদণ্ডে যথেষ্ট বিলাসবহুল। মেন্যুতে ছিল ভেড়ার মাংস, ভাজা মাছ, আলুর ঝোল, চিজ, তাজা রুটি ও মৌসুমি ফল।

তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীরা পেতেন পুষ্টিকর কিন্তু সহজ খাবার—পোরিজ, সেদ্ধ আলু, ভেড়ার ঝোল, আচার, রুটি, বিস্কুট, চিজ এবং চা-কফি।

কেন এত দামী ছিল টাইটানিকের খাবার?

১. বিলাসবহুল পরিবেশনা: টাইটানিককে শুধু পরিবহনের মাধ্যম নয়, বরং ভাসমান রাজপ্রাসাদ হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। তাই খাবারও ছিল আভিজাত্যের প্রতীক।

২. আনাড়ি বাজার নয়, ইউরোপীয় রাজকীয় মান: রান্নাগুলো ছিল ফরাসি শেফদের হাতে তৈরি, যাদের অনেকেই ইউরোপের রাজদরবারে কাজ করেছেন।

৩. বৈচিত্র্য ও আমদানিকৃত উপকরণ: তাজা ফল, উৎকৃষ্ট মানের ওয়াইন, সমুদ্রপথে আনা মাংস ও দুষ্প্রাপ্য উপকরণ মেন্যুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল।

৪. শ্রেণি বৈষম্য: প্রথম শ্রেণির টিকিটের দামই তখনকার সাধারণ মানুষের বছরের আয় সমান ছিল। স্বাভাবিকভাবেই তাদের খাবার ছিল বিলাসিতার সীমানা ছাড়ানো।

এক শতকের পুরনো মেনু কার্ড _

সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে টাইটানিকের একটি আসল মেনুকার্ড। সাদা কার্ডটি সময়ের ছোঁয়ায় লালচে হয়ে গেলেও খাবারের নামগুলো এখনও পরিষ্কার দেখা যায়। কার্ডের ডানদিকে লেখা— এপ্রিল ১১, ১৯১২। ওপরে রয়েছে একটি লাল পতাকা, তার মাঝে সাদা তারা—যেটি আজও টাইটানিকের পতাকার প্রতীক হিসেবে পরিচিত।

এই মেনু কার্ডটি মূলত ডুবন্ত জাহাজ থেকে কোনো যাত্রী উদ্ধার করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। পরে সেটি নিলামে ওঠে। সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত নিলামে মেনুকার্ডটির দাম উঠেছে ৮৩ হাজার পাউন্ড, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ টাকা।

কেন এত দাম?

টাইটানিকের মেন্যু কার্ড আজ এত দামে বিক্রি হওয়ার মূল কারণ শুধু খাবারের তালিকা নয়—এটি এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের ইতিহাস।

১. বিলাসিতা ও আভিজাত্য: এটি ছিল বিশ্বের ধনীদের জন্য তৈরি সবচেয়ে বিলাসবহুল সমুদ্রযাত্রার অংশ।

২. দুষ্প্রাপ্য দলিল: ১৯১২ সালের দুর্ঘটনায় জাহাজ ও স্মারকগুলো সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যায়। তাই অল্প কিছু আসল জিনিসের আজ বিরল মূল্য।

৩. স্মৃতি ও আবেগ: প্রায় ১৫০০ মানুষের মৃত্যুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে টাইটানিকের সঙ্গে। তাই এর প্রতিটি নিদর্শনই ইতিহাস ও আবেগের প্রতীক।

এক করুণ সমাপ্তি _

বিশ্বজোড়া পরিচিতি পাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যায় টাইটানিক। ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল উত্তর আটলান্টিকে একটি হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ফেটে যায় জাহাজ। সে রাতেই জাহাজটি ডুবে যায়, প্রাণ হারান অন্তত ১৫০০ জন যাত্রী। যে মেনু কার্ডটি আজ নিলামে কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেটি সেই বিপর্যয়ের তিন দিন আগের রেকর্ড।

বিশেষজ্ঞদের মতে, টাইটানিকের নিদর্শনগুলো কোনো ব্যক্তিগত সংগ্রহে নয়, বরং জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকা উচিত। কারণ এগুলো শুধু জাহাজডুবির স্মারক নয়, বরং মানুষের বিলাসিতা, প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এবং প্রকৃতির শক্তির সামনে অসহায়ত্বের দলিল।

কেননা, টাইটানিকের মেন্যু শুধু খাবারের নামের তালিকা নয়—এটি সামাজিক বৈষম্য, ধনীদের আভিজাত্য এবং সাধারণ মানুষের স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। যে জাহাজ এক রাতে সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গিয়েছিল, তার রন্ধনশৈলী এখনো মানুষকে কৌতূহলী করে রাখে।

সারাবাংলা/এফএন/এএসজি

টাইটানিক টাইটানিকের মেন্যু টাইটানিকের মেন্যুর দাম কেন এত বেশি?