আমাদের বাসযোগ্য এই পৃথিবী যেন এক বিশাল পরীক্ষাগার। কোথাও মাটি, কোথাও পানি, কোথাও বালু আবার কোথাও পাথরের স্তূপ— এভাবেই গঠিত আমাদের ভূমি। মাটি, পানি ও বালুর প্রাচুর্যের কারণে তাদের উপস্থিতি আমরা সহজে টের পাই না। কিন্তু পাথরের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে সীমিত, তাই এর হ্রাস-বৃদ্ধি মানুষের কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনেকে ভাবেন, ‘পাথরের তো জীবন নেই, তাহলে কীভাবে এর বৃদ্ধি ঘটতে পারে?’ সত্যিই, পাথরের কোনো হৃদস্পন্দন নেই, নেই শ্বাস-প্রশ্বাস। তবুও প্রকৃতির বিস্ময়কর কিছু ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া পাথরকে নতুন রূপ দেয়, বাড়ায় তার আকার, তৈরি করে রহস্যময় কাহিনি।
পাথরের জন্মকথা _
পৃথিবীর মাটির নিচে লুকিয়ে আছে অসংখ্য খনিজ লবণ। পটাশিয়াম (K), সোডিয়াম (Na), ক্যালসিয়াম (Ca), ম্যাগনেসিয়াম (Mg), লোহা (Fe), তামা (Cu), নিকেল (Ni) সহ বহু মৌল তাদের বিভিন্ন রেডিক্যাল (SO₄, CO₃, Cl, F, NO₃ ইত্যাদি) এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠন করে খনিজ লবণ। যখন এগুলো জলের অণুর সাথে মিলিত হয়, তখন তৈরি হয় এক বিশেষ স্ফটিক কাঠামো, যাকে বলা হয় Crystal Lattice।
সময় গড়াতে গড়াতে এই lattice বা স্ফটিক গঠন আরও মৌল, রেডিক্যাল, আয়ন ও জলের উপস্থিতিতে বড় হতে থাকে। ছোট ছোট স্ফটিক মিলিত হয়ে তৈরি করে একটি বড় শিলা বা পাথর। অর্থাৎ পাথরের বৃদ্ধি ঘটে—রাসায়নিক বিক্রিয়া ও খনিজের জমাট বাঁধার মাধ্যমে।
একটি বড় পাথর আসলে অসংখ্য ক্ষুদ্র স্ফটিকের আনবিক বন্ধনের ফসল। যেমন, ভাঙা অ্যামেথিস্ট (Amethyst) পাথরের ভেতরে আমরা ঝকঝকে বেগুনি স্ফটিক দেখি—এগুলোই ক্রিস্টাল ল্যাটিসের চমৎকার উদাহরণ।
রহস্যময় ‘বর্ধমান পাথর’ _
শুধু রাসায়নিক প্রক্রিয়া নয়, পৃথিবীর নানা প্রান্তে কিছু বিশেষ ধরনের শিলা পাওয়া যায়, যেগুলোকে স্থানীয়রা ‘জীবন্ত পাথর’ বলে ডাকেন।
রোমানিয়ার ট্রোভান্টস (Trovants): বৃষ্টির পর এ পাথরগুলো ফুলে ওঠে, বাইরের দিকে নতুন স্তর তৈরি হয়। ফলে মনে হয় এগুলো ‘বড় হচ্ছে’ বা ‘প্রজনন করছে।’
ইথিওপিয়া ও আফ্রিকার কিছু অঞ্চল: এখানে পাথরের স্তর আস্তে আস্তে জমে আকারে বড় হয়। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এগুলোতে প্রাণ আছে।
আসলে এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট ও সিলিকা থাকে। বৃষ্টির পানি শোষণ করে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে বাইরের অংশে নতুন খনিজ জমাট বাঁধে। এই প্রক্রিয়া হাজার বছরের ধীর-স্থির কাজের ফল, যা দেখে মানুষ মনে করে পাথর বাড়ছে।
পাথর কি জীবন্ত?
পাথর কখনো জীবন্ত নয়। এর কোনো কোষ নেই, প্রাণ নেই। তবে প্রকৃতির ভেতরকার রাসায়নিক ও ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াই পাথরের জন্ম দেয়, আকার বাড়ায়, ভাঙে কিংবা গলিয়ে ফেলে।
জীবের মতো জন্ম, মৃত্যু, প্রজনন পাথরের নেই। তবে ভূতাত্ত্বিক সময়ের হিসেবে এরও রয়েছে এক জীবনচক্র— সৃষ্টি, রূপান্তর, বিলীন।
তবে কি পাথরের বৃদ্ধি আসলে রহস্য _
পাথরের বৃদ্ধি আসলে রহস্য নয়, বরং প্রকৃতির এক বৈজ্ঞানিক খেলা। অণু-পরমাণুর জটিল বন্ধন, খনিজের জমাট বাঁধা আর হাজার বছরের ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠে এই ‘বর্ধমান’ পাথর। মানুষের চোখে এ রহস্য অদ্ভুত মনে হলেও, বিজ্ঞান জানায় এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা।
পৃথিবীর প্রতিটি পাথরই তাই সময়ের সাক্ষী— মহাকালের দীর্ঘ অধ্যায়ের এক একটি অধ্যায়।