Thursday 28 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মানুষ নয়; এখানে বসবাস করে শুধুমাত্র বিষধর সাপ!

ফারহানা নীলা
২৮ আগস্ট ২০২৫ ১৯:২৯

ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল থেকে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দূরে আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে জেগে উঠেছে এক ছোট্ট দ্বীপ— ইলহা দা কুইমাদা গ্রান্দে (Ilha da Queimada Grande)। বিশ্বের কাছে এটি বেশি পরিচিত স্নেক আইল্যান্ড নামে। মাত্র ৪৩ হেক্টর আয়তনের এই দ্বীপটি পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর স্থান, কারণ এখানে মানুষের পরিবর্তে আধিপত্য বিস্তার করেছে হাজার হাজার বিষধর সাপ। দ্বীপটিকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তি, ভয়ঙ্কর ইতিহাস এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিস্ময়কর গল্প।

সাপ আর কিংবদন্তির দ্বীপ _

স্নেক আইল্যান্ড সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প হলো— এক সময় জলদস্যুরা তাদের লুঠ করা সোনা ও দামী জিনিসপত্র এই দ্বীপে লুকিয়ে রাখত। তারপর সেগুলো পাহারা দেওয়ার জন্য ছেড়ে দিত বেশ কিছু সাপ। ধীরে ধীরে সাপগুলো বংশবৃদ্ধি করে পুরো দ্বীপ দখল করে নেয়।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে গবেষকরা বলেন, আজ থেকে প্রায় ১১ হাজার বছর আগে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে দ্বীপটি ব্রাজিলের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখনকার সাপেরা দ্বীপে আটকা পড়ে এবং প্রজনন বেড়ে যায় অবাধে। কোনও মানুষ না থাকার কারণে সাপের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। এখনকার হিসাবে, দ্বীপটির ৪ লক্ষ ৩০ হাজার বর্গমিটার জমিতে প্রায় সমান সংখ্যক সাপ বাস করে। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি বর্গমিটারে অন্তত এক থেকে পাঁচটি সাপ দেখা যায়।

ভয়ংকর গোল্ডেন ল্যান্সহেড _

স্নেক আইল্যান্ডের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী হলো গোল্ডেন ল্যান্সহেড ভাইপার (Bothrops insularis)। এই প্রজাতিটি পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই, একমাত্র এই দ্বীপেই এদের অস্তিত্ব। সূর্যের আলোয় এদের গায়ের হলুদাভ চামড়া সোনালি রঙ ধারণ করে বলে এ নামকরণ।

গোল্ডেন ল্যান্সহেডের বিষ মানুষের শরীরে রক্তপ্রবাহ ধ্বংস করে, টিস্যু গলিয়ে ফেলে এবং দ্রুত মৃত্যুর কারণ হয়। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো— এই বিষের কার্যকর প্রতিষেধক প্রায় নেই বললেই চলে। চিকিৎসা ছাড়া কামড়ে পড়লে জীবিত থাকার সুযোগ প্রায় শূন্য।

লাইটহাউসের করুণ ইতিহাস _

১৯০৯ সালে দ্বীপে নৌযানকে সতর্ক করার জন্য একটি লাইটহাউস নির্মিত হয়েছিল। প্রথমদিকে একজন নৌবাহিনীর অফিসার তার পরিবারসহ এখানে থাকতেন এবং বাতিঘরের দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু একদিন লাইটহাউসের জানালার ফাঁক দিয়ে এক বা একাধিক ল্যান্সহেড সাপ ঢুকে গিয়ে অফিসার, তার স্ত্রী এবং তিন সন্তানকে হত্যা করে। এরপর থেকে আর কাউকে স্থায়ীভাবে এখানে পাঠানো হয়নি। বর্তমানে লাইটহাউসটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হয়।

মৃত্যুর দ্বীপের ভয়ের গল্প _

লোককথায় শোনা যায়, একবার এক জেলে মাছ ধরতে গিয়ে খাবারের খোঁজে দ্বীপে প্রবেশ করেছিল। সেখানে তার চোখে পড়ে গাছে ঝুলে থাকা পাকা কলার কাঁদি। কিন্তু পরদিন দ্বীপে পাওয়া যায় তার রক্তাক্ত মৃতদেহ। তারপর থেকেই মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে— এই দ্বীপে পা দিলে কেউ আর জীবিত ফিরে আসে না।

প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য _

ভূপ্রকৃতি: দ্বীপের মাটি বেশিরভাগই পাথুরে ও উঁচুনিচু।
বনভূমি: ঘন চিরহরিৎ রেইন ফরেস্টে ঢাকা।
জীববৈচিত্র্য: সাপ ছাড়াও এখানে প্রচুর সমুদ্রপাখি আসে বিশ্রামের জন্য। তাদের ডাকেই মুখর থাকে জনমানবশূন্য দ্বীপ।
বিষধর প্রাণী: আশ্চর্যের বিষয়, দ্বীপে সাপ ছাড়া অন্য কোনো বিষধর প্রাণী নেই।

বিজ্ঞানীদের জন্য এক জীবন্ত ল্যাবরেটরি _

যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ, সেখানে জীববিজ্ঞানীরা গবেষণার উদ্দেশ্যে বিশেষ অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করেন। দ্বীপে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৫–৬ ঘণ্টা। ফলে কেউ কামড়ে পড়লে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার সুযোগ থাকে না।

সাও পাওলোর গবেষক মার্সেলো ডুয়ার্তে এ পর্যন্ত ২০ বারের বেশি স্নেক আইল্যান্ডে গিয়েছেন। তার পর্যবেক্ষণে দ্বীপে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার গোল্ডেন ল্যান্সহেড রয়েছে। তবে তিনি জানান, গত ১৫ বছরে সাপের সংখ্যা প্রায় ১৫ শতাংশ কমে গেছে। এর কারণ হলো খাদ্য-সংকট এবং চোরা শিকারিদের আক্রমণ।

প্রাণঘাতী বিষ থেকে প্রাণদায়ী ওষুধ _

গোল্ডেন ল্যান্সহেডের বিষ যেমন প্রাণঘাতী, তেমনি বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। গবেষকরা এই বিষ থেকে-
হৃদরোগ প্রতিরোধী ওষুধ,
রক্ত জমাট বাঁধা নিয়ন্ত্রণের ওষুধ,
ক্যানসার প্রতিরোধক ড্রাগ,
অ্যান্টিভেনম তৈরির উপাদান,
উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন। তাই অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ও বিজ্ঞানী স্নেক আইল্যান্ডকে সম্ভাবনাময় একটি প্রাকৃতিক গবেষণাগার হিসেবে দেখেন।

প্রকৃতির রহস্যময় খেলা _

স্নেক আইল্যান্ডকে ঘিরে যেমন রয়েছে ভয়ের গল্প ও কিংবদন্তি, তেমনি রয়েছে বৈজ্ঞানিক কৌতূহল। এই দ্বীপে মানুষের প্রবেশ প্রায় অসম্ভব হলেও গবেষণার জন্য এটি এক অমূল্য ভাণ্ডার। যেখানে একদিকে লুকিয়ে আছে মৃত্যু, অন্যদিকে সেখান থেকেই তৈরি হতে পারে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ। প্রকৃতির রহস্যময় খেলায় তাই স্নেক আইল্যান্ড দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়ংকর অথচ বিস্ময়কর দ্বীপ হিসেবে।

সারাবাংলা/এফএন/এএসজি

মানুষ নয়; এখানে বসবাস করে শুধুমাত্র বিষধর সাপ!

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর