একসময় ছিল, যখন অনুভূতি পৌঁছে দেওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। কাগজে ভাঁজ করা শব্দের ভেতর লুকিয়ে থাকত অপেক্ষা, অভিমান, ভালোবাসা কিংবা আশার গল্প। এখন ইমেইল, ইনবক্স, হোয়াটসঅ্যাপ— দ্রুত বার্তার জগতে কাগজে-কলমে লেখা সেই চিঠি যেন বিলুপ্তপ্রায় এক শিল্পকলা। তবুও এর আবেদন আজও হারায়নি।
এক টুকরো কাগজ, হাজারো অনুভূতি _
একজন প্রবাসী বাবা যখন ছেলেমেয়েকে দেশে বসে হাতে লেখা চিঠি পাঠাতেন, তখন সে কাগজ শুধু অক্ষরের বাহক থাকত না, বরং হয়ে উঠত আবেগের প্রতীক। লেখার মধ্যে লেগে থাকত বাবার হাতের ছোঁয়া, কলমের কালি হয়ে উঠত হৃদয়ের স্পন্দন।
ফ্যাশন ডিজাইনার সাকীতারা বললেন, ‘আমার বাবা মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করতেন। মাসে একবার ডাকবাক্সে তার চিঠি পেতাম। চিঠি হাতে নিলেই মনে হতো বাবা আমার সাথেই আছেন। আজও সেই চিঠিগুলো আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।’
চিঠির অপেক্ষা _
চিঠির সৌন্দর্যের বড় অংশই ছিল তার জন্য অপেক্ষা করা। ডাকপিয়নের সাইকেলের ঘণ্টা বেজে উঠলেই কিশোরীর বুক ধড়ফড় করত—প্রিয়জনের চিঠি এল কি? সেই অপেক্ষা, সেই উন্মাদনা, এখনকার ইমেইলের ‘seen’ বা টিক চিহ্নে পাওয়া যায় না।
প্রবীণ শিক্ষক সেলিম আহমেদ বললেন, ‘আমার প্রেমের শুরু হয়েছিল চিঠি দিয়েই। সপ্তাহে একবার আমি চিঠি লিখতাম, আর উত্তর আসত পরের সপ্তাহে। সেই প্রতীক্ষা আর উত্তেজনা আজকের প্রজন্ম কখনও বুঝবে না।’
চিঠির ঘ্রাণ _
পুরোনো চিঠির আরেক যাদু হলো ঘ্রাণ। কাগজের ভাঁজে জমে থাকা সুগন্ধি, অথবা স্রেফ সময়ের গন্ধ—তা মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় অতীতে। একেকটি চিঠি যেন একেকটি টাইম মেশিন।
গৃহিণী মেহজাবিন আক্তার শেয়ার করলেন, ‘স্বামীর কাছ থেকে প্রথম যে চিঠি পেয়েছিলাম, তাতে হালকা পারফিউমের গন্ধ মিশে ছিল। কাগজটা আজও আছে, গন্ধটা নেই, কিন্তু আবেগটা আজও অক্ষত।’
সময়ের পালাবদল _
আজকে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমরা তাত্ক্ষণিক বার্তা পাই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—গতি কি গভীরতাকে হার মানিয়েছে? হ্যাঁ, আজ চিঠি আর যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নয়, তবে হৃদয়ের গভীর অনুভূতি প্রকাশ করতে অনেকেই আবারও ফিরে যাচ্ছেন কাগজ ও কলমে।
কিশোর কবি রাফসান হোসেন জানালেন, ‘আমি মাঝে মাঝে ডায়েরিতে প্রিয়জনের উদ্দেশে চিঠি লিখে রাখি। হয়তো তা কখনও পৌঁছাবে না, তবু মনে হয় আমি আমার অনুভূতিগুলো কাগজে বাঁচিয়ে রাখতে পারছি।’
স্মৃতির বাক্সে চিঠি _
গ্রামবাংলায় প্রায় প্রতিটি ঘরে একসময় ছোট্ট একটা বাক্স থাকত—কেউ তাকে ডাকত লোহার ট্রাঙ্ক, কেউ কাঠের সিন্দুক। সেই বাক্সে যত্ন করে ভাঁজ করে রাখা থাকত পুরোনো চিঠি। কারও বাবা-মায়ের লেখা, কারও প্রেমিকার, কারও আবার বন্ধুর। সময়ের সঙ্গে অনেক কাগজ হলদেটে হয়ে গেছে, কালি ফিকে হয়ে গেছে, কিন্তু আবেগ হারায়নি একটুও।
আজও অনেক পরিবারে সেই বাক্স খুললেই ফিরে আসে অতীতের দিনগুলো। হাসি-কান্না, অভিমান-অপেক্ষা— সবই যেন ভেসে ওঠে হলদেটে পাতার অক্ষরে।
ডাকপিয়নের দিনগুলো _
একসময় গ্রামে ডাকপিয়নের সাইকেলই ছিল আনন্দ আর খবরের বাহক। দুপুর গড়ালেই মানুষ অপেক্ষায় থাকত—আজ কোনো চিঠি এল কি? ডাকপিয়নের হাতে হলুদ খামের ঝোলাই হয়ে উঠত আশা-নিরাশার প্রতীক।
এখন ডাকপিয়নের সাইকেলের সেই ঘণ্টাধ্বনি হারিয়ে গেছে শহরের হইচইয়ে, কিন্তু স্মৃতিতে তা আজও বেজে ওঠে।
চিঠি ফিরে আসুক _
কাগজে-কলমে লেখা চিঠি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রযুক্তি যত এগোই না কেন, মানবিক আবেগের গভীরতা কেবল হৃদয় থেকে হৃদয়ে পৌঁছায়। তাই চিঠি হারিয়ে না যাক। বরং বিশেষ মুহূর্তগুলোতে ফিরে আসুক। কারণ এক টুকরো চিঠি হয়ে উঠতে পারে অমূল্য স্মৃতি, যা ডিজিটাল যুগের তাত্ক্ষণিক মেসেজ কখনওই দিতে পারবে না। আর তাই – চিঠি লিখ প্রতিদিন…