গাজায় এখনও ধ্বংসস্তূপ, এখনও রক্ত আর উচ্ছেদ। বছরের পর বছর ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। নিজেদের ঘরবাড়ি হারিয়ে ঠাঁই হয়েছে শরণার্থী শিবিরে। কিন্তু এত কিছুর পরও একটি জিনিস আঁকড়ে ধরে আছেন ফিলিস্তিনিরা— নিজেদের বাড়ির চাবি।
কখনও কোনো তালায় আর বসানো হয় না সেই চাবি। ভাঙা দরজা, ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ির আর অস্তিত্ব নেই। তবু চাবি থেকে যায় পরিবারের কাছে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। এটি আর কেবল ধাতব বস্তু নয়, হয়ে ওঠে স্বপ্নের প্রতীক। একদিন হয়তো ফিরে আসা যাবে সেই হারানো ভিটায়— এই বিশ্বাসই ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার শক্তি।
নাকাবার স্মৃতি ও চাবির জন্ম _
১৯৪৮ সাল। ইতিহাসে পরিচিত ‘নাকাবা’ বা ‘দুর্যোগের বছর’ নামে। সেবার ইসরায়েলি আগ্রাসনে উচ্ছেদ করা হয় প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে। ধ্বংস করা হয় ৫ শতাধিক গ্রাম ও শহর। সেই উচ্ছেদের সময় অসংখ্য মানুষ চাবি হাতে নিয়েই ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, কয়েকদিনের মধ্যে ফিরে আসবেন।
কিন্তু সেই কয়েকদিনের অপেক্ষা বদলে গেছে কয়েক প্রজন্মের যন্ত্রণায়। ঘরবাড়ি আজও হারানো, অথচ চাবি এখনো অটুট। এ যেন সময়ের সীমানা পেরিয়ে যাওয়া এক জীবন্ত সাক্ষ্য।
আশ্রয় শিবিরে এক টুকরো আশা _
শরণার্থী শিবিরগুলোতে একেকটি চাবি মানে একেকটি ইতিহাস। শিশুদের হাতে বড় হয়ে ওঠা, বৃদ্ধদের কণ্ঠে স্মৃতির আবৃত্তি— সবকিছুর মাঝেই চাবি থাকে এক নীরব প্রতীক হয়ে।
এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে _
চাবি শুধু একটি বস্তু নয়, এটি উত্তরাধিকার। বাবা থেকে ছেলে, দাদী থেকে নাতি— এই প্রতীকী উত্তরাধিকার বয়ে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
ধ্বংসস্তূপেও দাঁড়িয়ে থাকা স্বপ্ন _
ইসরায়েলি বিমান হামলায় যখন গাজায় নতুন নতুন ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়, তখনও অনেক ফিলিস্তিনি ভাঙা দরজার তালা থেকে চাবি খুলে রাখেন। কেউ আবার ধ্বংসস্তূপে ফিরে গিয়ে খুঁজে আনেন ভিটের চিহ্ন হিসেবে পুরোনো চাবিটি।
তাদের কাছে এটি প্রতীক— যতবার ধ্বংস হোক, আশা কখনও ধ্বংস হয় না।
প্রতীকের শক্তি _
বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ মিছিলে, শিল্পকর্মে, কার্টুনে বারবার ফিরে আসে ফিলিস্তিনি চাবির প্রতীক। এটি শুধু ঘরের চাবি নয়, এটি স্বাধীনতার প্রতীক, প্রত্যাবর্তনের অঙ্গীকার।
ব্রিটিশ-প্যালেস্টাইন গবেষক লায়লা খালেদ একবার বলেছিলেন, ‘চাবি আমাদের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে। ইসরায়েল আমাদের ঘর ভেঙেছে, কিন্তু আমাদের স্বপ্ন ভাঙতে পারেনি।’
ফিরে আসার প্রত্যাশা _
গাজার মানুষ জানেন, হয়তো আগামীকাল নয়, কিন্তু একদিন তারা ফিরবেন নিজেদের ভিটায়। হাতে সেই পুরোনো চাবি, বুক ভরা আশা আর হৃদয়ে অমলিন স্মৃতির সঙ্গে।
চাবি তাই শুধু ধাতব বস্তু নয়, এটি ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বের দলিল। যুদ্ধ, আগ্রাসন, উচ্ছেদ—সবকিছুর মাঝেও একখণ্ড ধাতব চাবি বাঁচিয়ে রাখছে শতাব্দীর স্বপ্ন – ‘আমরা ফিরব আমাদের ঘরে’।