বাংলাদেশের লাখো মানুষের নিত্যদিনের বাজার করাকে সহজ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন ওয়াসিম আলিম। ২০১৩ সালে যখন তিনি চালডাল ডট কম (Chaldal.com) শুরু করেন, তখন তার কাছে ছিল শুধু একটি আইডিয়া আর একদল উদ্যমী সহকর্মী। সেই সময় অনলাইন গ্রোসারি শপিং ছিল এক অচেনা ধারণা। কিন্তু ওয়াসিম আলিমের স্বপ্ন ছিল এর মাধ্যমে মানুষের জীবনকে সহজ করে তোলা। তাদের এই স্বপ্নময় যাত্রা খুব সহজ ছিল না, ছিল প্রচুর চ্যালেঞ্জ। তবে, সঠিক সময়ে দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের থেকে ফান্ডিং পাওয়ায় তাদের সেই স্বপ্ন আজ পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম সফল অনলাইন প্ল্যাটফর্মে।
এই গাইডলাইনে ওয়াসিম আলিমের মতো হাজারো উদ্যোক্তার জন্য অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ এবং বৈশ্বিক সহায়তার বিষয়ে একটি বিস্তারিত ও বিশ্লেষণমূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
১. দেশীয় প্রতিষ্ঠান যারা ফান্ডিং ও সহায়তা দেয়ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (VC), প্রাইভেট ইক্যুইটি ফার্ম ও সরকারি সংস্থাএই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাবনাময় স্টার্টআপে বিনিয়োগ করে এবং ব্যবসার প্রবৃদ্ধিতে কৌশলগত সহায়তা দেয়। তারা সাধারণত উচ্চ প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করে।
বিনিয়োগের পর্যায় ও পরিমাণ _
* Seed বা প্রাথমিক পর্যায়: এই পর্যায়ে বিনিয়োগের পরিমাণ সাধারণত $10,000 থেকে $500,000 পর্যন্ত হয়ে থাকে।
* Series A বা পরবর্তী পর্যায়: ব্যবসার প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এই পর্যায়ের বিনিয়োগ $1 মিলিয়ন থেকে $5 মিলিয়ন পর্যন্ত হতে পারে।
* তারা যা দেখে: একটি শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ Founding Team, একটি উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক মডেল, বাজারের আকার ও চাহিদা এবং দ্রুত প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা (Scalability)।
* উদাহরণ: Startup Bangladesh Limited: বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 10 Minute School, রাইড-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম Pathao এবং সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম Sheba.xyz-এর মতো প্রতিষ্ঠিত উদ্যোগগুলোতে বিনিয়োগ করেছে। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম পিকাবো (Pickaboo)-ও এদের থেকে সহায়তা পেয়েছে।
* BD Venture Limited: তারা Chaldal, HandyMama এবং অটোমোবাইল সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম Zantrik-এর মতো প্রযুক্তি-ভিত্তিক উদ্যোগগুলোতে বিনিয়োগ করেছে।
* iDEA Project: এই প্রকল্প আইসিটি-নির্ভর উদ্যোক্তাদের, বিশেষ করে নারীদের, একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করে।
২. আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশী উদ্যোগের ফান্ডিংবাংলাদেশের বেশ কিছু সফল উদ্যোগ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মের কাছ থেকে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশি স্টার্টআপগুলোর বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা আছে।
* bKash: এটি বাংলাদেশের মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) খাতের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই প্রতিষ্ঠানটি Ant Group, SoftBank এবং Bill & Melinda Gates Foundation-এর মতো বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বড় আকারের বিনিয়োগ পেয়েছে।
* Chaldal.com: বাংলাদেশের অনলাইন গ্রোসারির বাজারে শীর্ষস্থানীয় এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু দেশীয় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল থেকেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকেও বড় অঙ্কের বিনিয়োগ পেয়েছে।
* Pathao: রাইড-শেয়ারিং, লজিস্টিকস এবং ফুড ডেলিভারি খাতের এই প্রতিষ্ঠানটিও বিদেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম, যেমন Go-Jek এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বিনিয়োগ পেয়েছে।
৩. ছোট ও স্থানীয় উদ্যোগ যারা ফান্ডিং পেয়েছেবাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে শুধু বড় প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, বরং অনেক ছোট এবং স্থানীয় পর্যায়ের উদ্যোগও দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে।
* PriyoShop: এই অনলাইন B2B মার্কেটপ্লেসটি মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (MSMEs) জন্য একটি সাপ্লাই চেইন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। PriyoShop Accelerating Asia, Bansea এবং Orbit Startups-এর মতো আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রি-সিরিজ এ (Pre-Series A) রাউন্ডে $5 মিলিয়ন ফান্ডিং পেয়েছে।
* Truck Lagbe: এটি একটি লজিস্টিকস প্ল্যাটফর্ম যা ট্রাক মালিক এবং ব্যবহারকারীদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। এই প্রতিষ্ঠানটি Startup Bangladesh Limited এবং IFC-এর মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ পেয়েছে।
* Shuttle: এই রাইড-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মটি শুধু মেয়েদের জন্য নিরাপদ পরিবহণের ব্যবস্থা করে। তারা SBK Tech Ventures এবং আন্তর্জাতিক কিছু ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম থেকে বিনিয়োগ পেয়েছে।
* Arogga: এটি একটি অনলাইন ফার্মেসি প্ল্যাটফর্ম। তারা দেশীয় ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীদের থেকে প্রাথমিক ফান্ডিং পেয়েছে।
৪. বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার স্টার্টআপ ফান্ডবাংলাদেশ ব্যাংক, দেশের উদীয়মান উদ্যোক্তাদের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে ৫০০ কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল (Refinancing Fund) গঠন করেছে। এই তহবিলটি স্টার্টআপগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ ও বিনিয়োগ সুবিধা প্রদানের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
* ফান্ডের মূল বৈশিষ্ট্য: মোট তহবিলের পরিমাণ: ৫০০ কোটি টাকা।
* ঋণের পরিমাণ: স্টার্টআপগুলো ২ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবে।
* সুদের হার: সর্বোচ্চ ৪% সুদে এই ঋণ পাওয়া যাবে।
* যোগ্যতা: বৈধ ট্রেড লাইসেন্স বা আরজেএসসি নিবন্ধিত বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান, যাদের পণ্য, সেবা বা প্রযুক্তিতে উদ্ভাবন রয়েছে। উদ্যোক্তার বয়স ন্যূনতম ২১ বছর হতে হবে।
যুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান:
* এই তহবিল বিতরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ১৬টি তফসিলি ব্যাংক এবং ৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হলো: * IPDC Finance PLC * Prime Bank PLC * Mercantile Bank PLC * BRAC Bank * United Commercial Bank (UCB)
* এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথমে নিজস্ব তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ করে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা নেয়।
৫. কোহর্ট, গ্রান্ট এবং লোন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিস্তারিত
* কোহর্ট বা ইনকিউবেটর: এই ধরনের প্রোগ্রাম পরিচালনা করে Orange Corners, Startup Bangladesh Limited, এবং BRAC Incubator। Grameenphone Accelerator তাদের প্রোগ্রামের জন্য প্রতিটি নির্বাচিত স্টার্টআপকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সিড ফান্ডিং দিয়েছে। এদের মধ্যে Sheba.xyz এবং স্বাস্থ্যসেবা প্ল্যাটফর্ম CMED Health উল্লেখযোগ্য।
* অনুদান (Grant): অনুদান প্রদান করে iDEA Project, Orange Corners, SAJIDA Foundation, এবং D-Prize। এই অনুদান সাধারণত ছোট আকারের হয়ে থাকে এবং প্রাথমিক পর্যায়ের উদ্যোগগুলোর জন্য খুবই সহায়ক।
* বিনিয়োগ বা ঋণ (Loan): বিনিয়োগ বা ঋণ প্রদান করে Startup Bangladesh Limited, BD Venture Limited, Fenox Ventures, এবং Truvalu। এছাড়াও Bangladesh Bank ও বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ, Grameen Bank এবং ASA ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদান করে।
৬. উদ্যোক্তার অপরিহার্য দক্ষতা এবং প্রস্তুতিযেকোনো ধরনের ফান্ডিং বা সহায়তা পেতে হলে উদ্যোক্তাকে তার ব্যবসার মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে এবং কিছু ব্যক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
* ব্যবসার মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা: Business Planning: একটি সুসংগঠিত ব্যবসায়িক পরিকল্পনা থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
* Financial Management: আপনার ব্যবসার আর্থিক প্রক্ষেপণগুলো (financial projections) সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে।
* Market Research: আপনার পণ্য বা সেবার জন্য বাজারে কতটা চাহিদা আছে, প্রতিযোগীরা কী করছে, সে বিষয়ে আপনার গভীর জ্ঞান থাকতে হবে।
* Legal & Institutional Knowledge: ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স ও অন্যান্য আইনি বিষয় সম্পর্কে আপনার জ্ঞান থাকা উচিত।
* উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত দক্ষতা ও সক্ষমতা: Leadership & Management: একটি দক্ষ দল গঠন এবং তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। বিনিয়োগকারীরা প্রায়শই বলেন, “আমরা আইডিয়াতে নয়, বরং টিমে বিনিয়োগ করি।”
* Communication Skills: আপনার আইডিয়াটি বিনিয়োগকারী বা ফান্ডিং প্রদানকারীর কাছে কার্যকরভাবে উপস্থাপন করার সক্ষমতা থাকতে হবে। একটি ভালো Pitch Deck তৈরি করা এই দক্ষতার অংশ।
* Resilience & Problem-Solving: ব্যবসার পথে আসা যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য আপনার মানসিক দৃঢ়তা থাকা উচিত।
৭. কতটুকু ক্ষমতা থাকলে ফান্ডিং পাওয়া যায়?ফান্ডিং পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো ‘ক্ষমতা’ বা যোগ্যতার মানদণ্ড নেই, তবে কিছু বিষয় আপনার সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
* Proven Track Record: আপনি যদি আপনার আইডিয়াটি ইতোমধ্যে কিছুটা হলেও বাস্তবায়ন করে থাকেন, তাহলে ফান্ডিং পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মগুলো সাধারণত Product-Market Fit খুঁজে থাকে।
* আর্থিক অবস্থা: ঋণ বা লোন পাওয়ার জন্য আপনার ব্যবসার আর্থিক সচ্ছলতা এবং আয়ের একটি স্থিতিশীল উৎস থাকা জরুরি।
* Networking: বিভিন্ন স্টার্টআপ ইভেন্ট, সেমিনার এবং ওয়ার্কশপে অংশ নিয়ে বিনিয়োগকারী, পরামর্শদাতা এবং অন্যান্য উদ্যোক্তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ।
সংক্ষেপে, সফলভাবে ফান্ডিং পেতে হলে উদ্যোক্তাকে তার আইডিয়া, আর্থিক পরিকল্পনা এবং ব্যক্তিগত সক্ষমতা—এই তিনটি বিষয়েই দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব