Thursday 18 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সোনালি আঁশের দেশ থেকে ‘বৈচিত্র্যের বাংলাদেশ’: কেন বদলাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্র?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৬:২২

বাংলাদেশ শুধু তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ নয়, বরং হাজার বছরের পুরোনো সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এক জাতি। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা নিজেদেরকে বৈচিত্র্যময় দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পারি। এক সময় ‘সোনালি আঁশ’ হিসেবে পরিচিত পাটই ছিল আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, তবে এখন সময় এসেছে হাজারো দেশীয় পণ্যের বিশ্বজোড়া পরিচিতি ঘটানোর। এই যাত্রাকে সফল করতে প্রয়োজন সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও সমন্বিত উদ্যোগ।

ঐতিহ্যবাহী বা দেশীয় পণ্য: একটি ধারণাঐতিহ্যবাহী বা দেশীয় পণ্য বলতে এমনসব জিনিস বোঝায়, যা দীর্ঘকাল ধরে বংশপরম্পরায় কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি, দক্ষতা এবং জীবনধারার সঙ্গে জড়িত। এই পণ্যগুলো কেবল বাণিজ্যিক উপকরণ নয়, বরং একটি জাতির ইতিহাস ও কারিগরি দক্ষতার প্রতিচ্ছবি।

বিজ্ঞাপন

এগুলোকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:

*ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) পণ্য: যেসব পণ্যের গুণগত মান বা সুনাম নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের কারণে হয়, সেগুলোকে জিআই পণ্য বলা হয়। যেমন: জামদানি, ইলিশ মাছ, ফজলি আম এবং ঢাকাই মসলিন।

* হাতে তৈরি কারুশিল্প: স্থানীয় কারিগরদের হাতে তৈরি এই পণ্যগুলোতে শিল্পীর নিজস্ব সৃজনশীলতার ছাপ থাকে। যেমন: নকশিকাঁথা, শতরঞ্জি, বাঁশ-বেতের পণ্য, মৃৎশিল্প এবং কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্র।

* কৃষি ও খাদ্যভিত্তিক পণ্য: দেশের মাটি ও জলবায়ু থেকে উৎপাদিত কিছু বিশেষ খাদ্য ও কৃষি পণ্য আমাদের সংস্কৃতির অংশ। যেমন: বগুড়ার দই, সিলেটের চা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম।

* বংশগত শিল্প: হাজার হাজার বছর ধরে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত শিল্প। যেমন: খাদি, যা হাতে বোনা পরিবেশবান্ধব এক ধরনের কাপড়।

১. বাংলাদেশের পণ্য ও সম্ভাবনা: এক নতুন দিগন্তের হাতছানিআমাদের পণ্যগুলো কেবল অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি নয়, বরং সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি, যা বৈশ্বিক বাজারে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

ঐতিহ্যবাহী পণ্য:

* পাট ও পাটজাত পণ্য: একসময় ‘সোনালি আঁশ’ হিসেবে পরিচিত পাট এখন পরিবেশবান্ধব পণ্যের প্রতীক। পাট থেকে তৈরি ব্যাগ, জুতা, শতরঞ্জি ও পোশাকের বৈশ্বিক চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে রপ্তানি আয় প্রায় $১.৫ বিলিয়ন ডলার।

* হস্তশিল্প ও কারুশিল্প: নকশিকাঁথা, শতরঞ্জি, বাঁশ-বেতের পণ্য এবং জামদানি শাড়ি হাতে তৈরি শৈল্পিকতার অনন্য উদাহরণ। রংপুরের শতরঞ্জি, যার বাজার প্রায় $১০-১৫ মিলিয়ন ডলার, ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছে।

* ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) পণ্য: জামদানি, ইলিশ, ফজলি আম এবং ঢাকাই মসলিন জিআই ট্যাগ পেয়েছে। এটি তাদের আইনি সুরক্ষা ও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি করে।

কৃষি ও মৎস্য সম্পদ:

* মৎস্য ও হিমায়িত খাদ্য: ইলিশ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এর পাশাপাশি চিংড়ি, কাঁকড়া ও বিভিন্ন হিমায়িত খাদ্য পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই খাত থেকে বছরে প্রায় $৫০-৭০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হয়।

* শাকসবজি ও ফলমূল: ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশি শাকসবজি ও ফলমূলের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।

*সেবা ও প্রযুক্তি: তথ্যপ্রযুক্তি ও ফ্রিল্যান্সিং: বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ফ্রিল্যান্সিং হাব। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো সেবা রপ্তানি করে তরুণরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।

* সফটওয়্যার ও অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট: আমরা নিজস্ব সফটওয়্যার ও অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করে বিশ্ববাজারে সরবরাহ করতে পারি, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আর্থিক খাতে।

২. রপ্তানি প্রক্রিয়া ও চ্যালেঞ্জ:

বাস্তবতার একাল সেকালদেশীয় পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট বাধা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

* সরকারি প্রতিবন্ধকতা ও সার্টিফিকেশন: রপ্তানি প্রক্রিয়ায় প্রধান বাধা হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং প্রয়োজনীয় সনদপত্রের অভাব। কৃষি ও খাদ্যজাত পণ্যের জন্য ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট এবং মৎস্যজাত পণ্যের জন্য মান সনদ পেতে দীর্ঘ সময় লাগে।

* পেমেন্ট গ্রহণ: আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গ্রহণ করা ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য কঠিন। লেটার অফ ক্রেডিট (L/C) নিরাপদ হলেও প্রক্রিয়া দীর্ঘ। ছোট অংকের লেনদেনের জন্য অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়েগুলো এখনও সহজলভ্য নয়।

* কম খরচে পরিবহন: পরিবহন খরচ, বিশেষত আকাশপথে, বেশি হওয়ায় তা দেশীয় পণ্যের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। সমুদ্রপথে পরিবহন সাশ্রয়ী হলেও সময়সাপেক্ষ।

* মেধাস্বত্ব অধিকার ও সুরক্ষা: জিআই ট্যাগ থাকার পরও নকশার স্বত্ব (copyright) এবং ট্রেডমার্ক (trademark) সুরক্ষার অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিদেশি বাজারে পণ্যের নকশা নকল হওয়ার প্রবণতা বেশি, যা কারিগরদের ক্ষতির কারণ হয়।

৩. ই-কমার্স ও দেশীয় পণ্য: সম্ভাবনার নতুন দিগন্তই-কমার্স দেশীয় পণ্যগুলোকে বিশ্ববাজারে সরাসরি পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে।

* বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা: হাতে তৈরি গহনা, নকশিকাঁথা, শতরঞ্জি এবং ঐতিহ্যবাহী পোশাক বর্তমানে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং স্থানীয় ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এটসি (Etsy), আমাজন (Amazon) এবং আলিবাবা (Alibaba)-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো বাংলাদেশি কারিগরদের জন্য বিশাল বাজার খুলে দিয়েছে।

* সরাসরি রপ্তানি: ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর সুযোগ দেয়, এতে বিক্রেতারা ন্যায্য মূল্য পায়।

* চ্যালেঞ্জ: আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে, যেমন পেপাল (PayPal), বাংলাদেশে সহজলভ্য না থাকা এবং ছোট চালানের লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনা প্রধান চ্যালেঞ্জ।

৪. বাজার ও কৌশল: কোথায় এবং কীভাবে পৌঁছাব?

* মেলা ও প্রদর্শনীর ভূমিকা: আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা, যেমন জার্মানির Heimtextil, নতুন বাজার খুঁজে পেতে এবং পণ্যের পরিচিতি বাড়াতে অত্যন্ত কার্যকর।

* সম্ভাবনাময় বাজার ও বিদেশি সহযোগিতা: প্রধান বাজার হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং জাপান।

* বিদেশী দূতাবাস ও সংস্থার ভূমিকা: যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দেশগুলোর দূতাবাস নিয়মিত বাংলাদেশি হস্তশিল্প ও সাংস্কৃতিক পণ্য প্রদর্শনী আয়োজন করে থাকে।

* ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং: ‘Made in Bangladesh’ ট্যাগকে কেবল সস্তা শ্রমের প্রতীক না করে, গুণগত মান ও সৃজনশীলতার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৫. মানবিক দিক ও পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংযোগ

* পণ্যের পেছনের গল্প: গ্রামীণ কারিগরদের জীবন এবং শিল্পকর্মের গল্পগুলো তুলে ধরলে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পণ্যের মানবিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি পাবে।

* পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংযোগ: সুন্দরবন বা সিলেটের চা বাগানের মতো স্থানে ইকো-ট্যুরিজমকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় হস্তশিল্প ও খাবারের সরাসরি বাজার তৈরি করা যেতে পারে।

৬. সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা: একযোগে কাজ করার গুরুত্ব

* নীতিমালা ও প্রণোদনা: সরকার নগদ প্রণোদনা দিলেও, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও শুল্ক প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করতে হবে।

* সফলতার গল্প: আড়ং এবং ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো প্রমাণ করেছে যে স্থানীয় কারুশিল্পকে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডে পরিণত করা সম্ভব।

* এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ভূমিকা: ব্র্যাকের মতো এনজিওগুলো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করছে। বিদেশি সংস্থা যেমন UNDP এবং বিশ্বব্যাংকও এই খাতে সহায়তা দিয়ে থাকে।

৭. আগামী দিনের কৌশল: এক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ

* দূতাবাসগুলোর ভূমিকা: দূতাবাসগুলো সারা বছর বাণিজ্যিক কূটনীতি (commercial diplomacy) পরিচালনা করে মার্কেট ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করতে পারে।

* নীতিমালা সহজীকরণ: ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে কাঁচামালের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করা যেতে পারে। এছাড়া, রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি একীভূত শুল্ক কাঠামো (unified tax structure) তৈরি করা হলে প্রক্রিয়াটি সহজ হবে। একটি ওয়ান-স্টপ সার্ভিস (one-stop service) চালু করা গেলে সব ধরনের সনদ দ্রুত পাওয়া যাবে।

* প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন: পণ্যের মান ও সরবরাহ চেইন নিশ্চিত করতে ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রেতাদের আস্থা বাড়াবে।

* গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D): ঐতিহ্যবাহী পণ্যের নকশা ও উৎপাদনে আধুনিকতার ছোঁয়া আনতে বিনিয়োগ জরুরি।

* মানবসম্পদ উন্নয়ন: শ্রমিক ও কারিগরদের আধুনিক প্রযুক্তি এবং ভাষা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

* আন্তর্জাতিক চুক্তি: বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) করার উদ্যোগ নিতে হবে।

৮. চূড়ান্ত সম্ভাবনা ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যবর্তমানে আমাদের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের রপ্তানি আয় প্রায় $১.৫ বিলিয়ন ডলার। যদি সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর হয় এবং সমন্বিত সহযোগিতা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এই বাজারকে অনায়াসে $১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করা সম্ভব। বিশ্বের হাতে তৈরি পণ্যের বাজারের মাত্র ২-৩% দখল করতে পারলেও তা তৈরি পোশাক শিল্পের পরের বৃহত্তম রপ্তানি খাত হিসেবে আবির্ভূত হবে।

বাংলাদেশ তার হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে একটি নতুন অর্থনৈতিক পরিচয় নির্মাণের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। তৈরি পোশাক শিল্পের সফলতার পাশাপাশি, আমাদের ঐতিহ্যবাহী ও দেশীয় পণ্যগুলোর যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে, তা আজ স্পষ্ট। এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন কেবল সুচিন্তিত নীতি, সমন্বিত সহযোগিতা এবং একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। সরকারের সহজ নীতিমালা, দূতাবাসগুলোর সক্রিয় ভূমিকা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পাশে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তাই পারে ‘সোনালি আঁশের দেশ’ থেকে বাংলাদেশকে ‘বৈচিত্র্যের বাংলাদেশ’ হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে। আমাদের ঐতিহ্য আমাদের শক্তি, এবং এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্রে এক নতুন ও উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করতে পারি।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

সারাবাংলা/এনএল/এএসজি

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা) সোনালি আঁশের দেশ থেকে ‘বৈচিত্র্যের বাংলাদেশ’: কেন বদলাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্র?

বিজ্ঞাপন

ফেসবুকে মনিটাইজেশন পাওয়ার উপায়
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৬:০৪

বিশাল জারা লেবু: সিলেট থেকে বিদেশে
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৫:৪৮

আরো

সম্পর্কিত খবর