বাংলার ইতিহাসে নবাব সিরাজউদ্দৌলার নাম উচ্চারণ মানেই আসে শৌর্য, বীরত্ব আর বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি। সেই নবাব পরিবারের অষ্টম বংশধর ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা ছিলেন আধুনিক বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতে এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি শুধু একজন দক্ষ প্রকৌশলীই নন, ছিলেন সৎ, মানবিক ও সংগ্রামী এক মানুষ—যিনি নিজের কর্মগুণে, সততায় এবং দানের মহিমায় মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন।
শৈশব, শিক্ষা ও বংশীয় ঐতিহ্য
সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা জন্মেছিলেন ঐতিহাসিক এক বংশপরম্পরায়। তার পিতা সৈয়দ গোলাম মুর্তজা ও মাতা নিখাত আরা ছিলেন সজ্জন, শিক্ষিত ও সমাজমনস্ক মানুষ। ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি কখনো আভিজাত্যের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেননি। বরং মেধা, অধ্যবসায় আর শ্রম দিয়েই নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তুলেছিলেন।
বংশীয় মর্যাদার কারণে অনেকেই হয়তো অলস, ভোগবাদী জীবন বেছে নিতেন, কিন্তু গোলাম মোস্তাফা ছোটবেলা থেকেই ছিলেন পরিশ্রমী ও কৌতূহলী। প্রযুক্তি আর বিদ্যুৎ খাতের প্রতি ছিল তার বিশেষ আগ্রহ, যা পরবর্তীতে তাকে নিয়ে যায় প্রকৌশল জগতে।
প্রকৌশল জীবন: বিদ্যুৎখাতের বীর সৈনিক
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে কর্মজীবন শুরু করে দ্রুতই নিজেকে আলাদা করে তুলেছিলেন গোলাম মোস্তাফা। তার প্রধান অবদান ছিল— টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত দেশের বিদ্যুতায়নে। অসংখ্য বিদ্যুতের খুঁটি, টাওয়ার ও নকশা তার হাত ধরে দাঁড়িয়েছে।
তিনি ছিলেন শুধু প্রকৌশলী নন, বিদ্যুতের দুর্ঘটনা ও বিপর্যয়ের সময় দেশের সর্বশেষ ভরসা। হঠাৎ যদি কোনো পাওয়ার গ্রিড ভেঙে পড়ত, বা বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটত—তাহলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে একটি কথাই শোনা যেত: ‘এস. জি. মোস্তাফার হাতে দিন, উনি সমাধান করে দেবেন।’
তার সহকর্মীরা এখনো বলেন, জনাব গোলাম মোস্তাফার দক্ষতা, পরিকল্পনা আর তীক্ষ্ণ সিদ্ধান্তের কারণে অনেক বিপর্যয় মুহূর্তেই এড়ানো সম্ভব হয়েছে।
মানবিকতা ও দানশীলতা
তিনি নিজের আয়ের বেশিরভাগই ব্যয় করতেন মানুষের জন্য। উপার্জনের দুই-তৃতীয়াংশ নিয়মিত ব্যয় হতো দুঃস্থ মানুষ, সমাজসেবামূলক সংগঠন এবং ইসলামী প্রতিষ্ঠানের পেছনে। পরিবার বা আত্মীয়-স্বজন কেউ বিপদে পড়লে তিনি ছিলেন সবার আগে।
মজার ব্যাপার হলো, তিনি কখনো এই দান বা সাহায্যের প্রচার করতেন না। নীরবে, নিভৃতে মানুষের পাশে দাঁড়াতেন।
স্বভাব, চরিত্র ও বন্ধুত্ব
সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা ছিলেন প্রাণবন্ত ও হাস্যরসিক স্বভাবের মানুষ। সাহসী, স্পষ্টভাষী এবং অকপট মত প্রকাশকারী হিসেবে তিনি আলাদা ছিলেন। কারো সঙ্গে অন্যায় দেখলে চুপ করে থাকতেন না।
বন্ধু, সহকর্মী, আত্মীয়— সবাই তার প্রাণখোলা হাসি, গল্প, আন্তরিকতা আজো মনে রেখেছেন। তবে তিনি শুধু হাস্যরসিকই ছিলেন না— গভীর দুঃখবোধও ছিল তার ভেতরে। অন্যায়-অবিচার বা মানুষের দুর্দশা তাকে কষ্ট দিত। তবে তিনি বলতেন, ‘কাঁদলে সমাধান হয় না, সংগ্রাম করতে হয়।’
পারিবারিক জীবন
তার সহধর্মিণী মহীয়সী নারী সৈয়দা হোসনে আরা বেগম ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সহধর্মিনী বেগম লুৎফুন্নিসার বংশধর। এই দম্পতির সংসার ছিল সুখী ও আদর্শ। তাদের সন্তানরা— নাজনীন, সাকিনা, মাসুম ও সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব (নবাবজাদা আলি আব্বাসউদ্দৌলা) আজ তাদের উত্তরাধিকার বহন করছেন।
পরিবারে তিনি ছিলেন আশ্রয়দাতা বটবৃক্ষের মতো। শুধু নিজের সন্তান নয়, নবাব পরিবারের অনেকে জীবনের নানা পর্যায়ে তার ওপর নির্ভর করেছেন।
মৃত্যু ও চিরবিদায়
২০২৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, রাষ্ট্রের অবহেলা চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভুল চিকিৎসার প্রয়োগ এবং নানা বিধ ষড়যন্ত্রের কারণে সময়ের পূর্বেই তিনি ইন্তেকাল করেন। তার এই অকাল প্রয়াণ শুধু পরিবার নয়, প্রকৌশলী সমাজ ও বিদ্যুৎখাতের জন্যও এক বিরাট শূন্যতা তৈরি করেছে।
তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, প্রাণপ্রিয় সহধর্মিণী মহীয়সী নারী সৈয়দা হোসনে আরা বেগমের কবরেই তাকে সমাহিত করা হয়। সেই সমাধিস্থলে আজও মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে যায়।
উত্তরাধিকার ও স্মরণ
ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা ছিলেন শুধু নবাব সিরাজউদ্দৌলার অষ্টম বংশধর নন, ছিলেন আধুনিক বাংলাদেশের এক অক্লান্ত সৈনিক। বিদ্যুৎখাতে তার অবদান, মানবিকতায় তার দানশীলতা, ব্যক্তিত্বে তার সাহসী মনোভাব— সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক পূর্ণাঙ্গ মানুষ।
তার সহকর্মীরা বলেন, ‘এমন মানুষ বারবার জন্মায় না।’ তার পরিবার মনে করে, ‘তিনি ছিলেন আমাদের আশ্রয়, শক্তি, দিশারী।’আর বাংলার ইতিহাসে বাংলার ঐতিহ্যবাহী নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরিবারের ইতিহাসে তার নাম আজীবন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
বাংলার সাহসী বীর সন্তান ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা রেখে গেছেন এক উজ্জ্বল উত্তরাধিকার— ‘নবাবজাদা আলি আব্বাসউদ্দৌলা’, যা শুধু নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরিবারের গৌরব নয়, পুরো বাংলাদেশেরই সম্পদ।