বর্তমান বিশ্বকে বলা হয় প্রযুক্তির যুগ। যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন থেকে শুরু করে অর্থনীতি—সব ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। অর্থনৈতিক বা আর্থিক পরিকল্পনা হলো এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে সঠিক হিসাব ও নির্ভুল পূর্বাভাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিকল্পনা ব্যক্তিগত জীবন, ব্যবসা বা জাতীয় অর্থনীতির জন্য সমানভাবে জরুরি। আর এই আর্থিক পরিকল্পনাকে কার্যকর ও বাস্তবমুখী করতে গণিত ও প্রযুক্তির সমন্বয় অপরিহার্য।
অর্থ ব্যবস্থাপনায় গণিত সবসময় একটি মৌলিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আয়-ব্যয়, বাজেট, সঞ্চয়, বিনিয়োগ, ঋণ— প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণিতের প্রয়োগ রয়েছে।
চক্রবৃদ্ধি সুদ ও ভবিষ্যৎ মূল্য নির্ধারণ: ব্যাংকিং বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টাকা সময়ের সাথে কিভাবে বাড়বে তা জানার জন্য চক্রবৃদ্ধি সুদের সূত্র ব্যবহার করা হয়।
বাজেট তৈরি: মাসিক বা বাৎসরিক বাজেট করতে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের মতো প্রাথমিক গণিত অপরিহার্য।
ঝুঁকি ও সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণ: বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকি কতটা, লাভের সম্ভাবনা কতটা—এসব পরিমাপে সম্ভাব্যতার সূত্র ও পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়।
লাভ-ক্ষতি হিসাব: ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে খরচ, আয় ও লাভের তুলনা করতে বীজগণিত ও গাণিতিক মডেল প্রয়োগ করা হয়।
আগের যুগে আর্থিক পরিকল্পনা হতো কাগজ-কলমে; সময় লাগত বেশি, ভুলের সম্ভাবনাও থাকত। কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তি পুরো প্রক্রিয়াটিকে বদলে দিয়েছে।
স্প্রেডশিট ও ফাইন্যান্স সফটওয়্যার: মাইক্রোসফট এক্সেল, গুগল শিটস বা অন্যান্য বিশেষ ফাইন্যান্স অ্যাপ ব্যবহার করে এখন সহজেই বাজেট তৈরি, সুদ হিসাব, খরচ বিশ্লেষণ করা যায়।
ডেটা অ্যানালিটিক্স: বড় আকারের আর্থিক তথ্য (বিগ ডেটা) বিশ্লেষণে কম্পিউটারভিত্তিক পরিসংখ্যানিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।
অ্যালগরিদমিক ট্রেডিং: শেয়ারবাজারে অ্যালগরিদম বা গাণিতিক সূত্রের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেনা-বেচার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা মানুষের চেয়ে দ্রুত ও নির্ভুল।
মোবাইল ফাইন্যান্স ও ডিজিটাল ব্যাংকিং: এখন মোবাইল ফোনেই টাকা পাঠানো, বিল পরিশোধ, সঞ্চয় বা বিনিয়োগ সম্ভব হচ্ছে। এসব অ্যাপ ব্যাকএন্ডে জটিল গাণিতিক হিসাব করে।
প্রযুক্তি মূলত গণিতের অ্যালগরিদম, সূত্র ও মডেলকে কম্পিউটারভিত্তিক করে দ্রুত ফলাফল দেয়।বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ মূল্য বা EMI (কিস্তি) বের করতে চক্রবৃদ্ধি সূত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসাব করে দেয় ফাইন্যান্স অ্যাপগুলো।ঝুঁকি বিশ্লেষণে পরিসংখ্যানগত মডেল ব্যবহার করে কয়েক সেকেন্ডেই সম্ভাব্য ফলাফল দেওয়া যায়।বাজেট পরিকল্পনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) অতীত খরচের ধারা দেখে ভবিষ্যৎ খরচের অনুমান করতে পারে।
ব্যক্তিগত জীবনে বেতন, সঞ্চয়, ঋণ, শিক্ষা খরচ, বাড়ি কেনা ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। গণিত ও প্রযুক্তির যুগল প্রয়োগ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাজেট অ্যাপ: মাসিক খরচ ও আয় ট্র্যাক করতে অ্যাপ সাহায্য করে।
ঋণ ক্যালকুলেটর: ভবিষ্যতে কত কিস্তি দিতে হবে, মোট কত সুদ হবে—এসব তথ্য অনলাইনে ক্যালকুলেটর দিয়েই জানা যায়।
সঞ্চয় পরিকল্পনা: নির্দিষ্ট সময়ে কত টাকা জমবে তা অ্যাপ আগে থেকেই জানিয়ে দেয়।
শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়েই নয়, ব্যবসা বা জাতীয় অর্থনীতিতেও প্রযুক্তি ও গণিতের সমন্বয় অপরিহার্য।
বাজেট তৈরি: সরকারি বাজেটের আয়-ব্যয়, ঘাটতি, উন্নয়ন ব্যয় ইত্যাদি অনুমান করতে পরিসংখ্যানিক মডেল ব্যবহৃত হয়।
বিনিয়োগ বিশ্লেষণ: বড় প্রকল্পে বিনিয়োগের আগে লাভ-ক্ষতির সম্ভাব্যতা নিরূপণে গণিতনির্ভর সফটওয়্যার ব্যবহার হয়।
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা: বৈদেশিক মুদ্রা বাজার, শেয়ারবাজার বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঝুঁকি কমাতে গণিতনির্ভর মডেল সাহায্য করে।
আগামী দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা, ব্লকচেইন ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের সঙ্গে গণিতের ব্যবহার আরও গভীর হবে। অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা বাড়বে, যেখানে গণিত হবে প্রযুক্তির মূলভিত্তি। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকের ক্রেডিট স্কোর নির্ধারণ বা প্রতারণা শনাক্তকরণে গণিতনির্ভর অ্যালগরিদম ও AI একসঙ্গে কাজ করবে।
প্রযুক্তি আর গণিতকে পাশে রেখে আর্থিক পরিকল্পনা করলে তা হয় কার্যকর, ঝুঁকিমুক্ত ও ভবিষ্যৎমুখী। ব্যক্তিগত, ব্যবসায়িক কিংবা জাতীয়—সব স্তরেই এই সমন্বয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের পথে বড় ভূমিকা রাখে। বর্তমান যুগে প্রযুক্তি ও গণিত ছাড়া আর্থিক পরিকল্পনা কল্পনাই করা যায় না। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আর্থিক শিক্ষার পাশাপাশি গণিত ও প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়