কখনও কি ভেবে দেখেছেন, মোবাইল পেমেন্টের সময় যে ছোট্ট সাদা-কালো ঘনবদ্ধ বর্গাকার ছবিটিতে আমরা ফোন ক্যামেরা তাক করি, তার পেছনের গল্পটা কেমন? সেই ছবি বা কোডের নাম QR Code—Quick Response Code। আর এর উদ্ভাবক জাপানের প্রকৌশলী মাসাহিরো হারা।
১৯৯৪ সালে তিনি এই প্রযুক্তি তৈরি করেছিলেন একেবারেই ব্যবহারিক একটি উদ্দেশ্যে— গাড়ির যন্ত্রাংশ সহজে ট্র্যাক করার জন্য। কিন্তু তার তৈরি ছোট্ট এই উদ্ভাবন আজ পৃথিবীজুড়ে এক বিশাল বিপ্লব ঘটিয়েছে। মোবাইল পেমেন্ট থেকে শুরু করে ট্রেনের টিকিট, খাবারের মেন্যু, এমনকি কোভিড ভ্যাকসিনের সার্টিফিকেট পর্যন্ত—সবখানেই এখন QR কোড আমাদের নিত্যসঙ্গী।
পেটেন্টহীন এক মহৎ উপহার
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, হারা এই প্রযুক্তির পেটেন্ট নেননি। চাইলে তিনি কোটি কোটি ডলারের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন, পৃথিবীর মানুষ যেন কোনো বাধা ছাড়াই এটি ব্যবহার করতে পারে। ফলাফল? আজ QR কোড মানবজাতির এক অবিশ্বাস্য সম্পদে পরিণত হয়েছে।
এর Error Correction প্রযুক্তি এতটাই কার্যকর যে কোডের একটি অংশ নষ্ট হয়ে গেলেও বা ছিঁড়ে গেলেও সহজেই পড়া যায়। অর্থাৎ, এটি শুধু সহজ নয়, বরং নির্ভরযোগ্যও।
হারা নিজে কোটিপতি হননি, কিন্তু তিনি প্রমাণ করেছেন— মানবকল্যাণের জন্য উদ্ভাবনই আসল সম্পদ।
আমাদের প্রশ্ন— আমরা পারছি না কেন?
এখানেই আমাদের ভাবনার জায়গা। বাঙালিরাও কম মেধাবী নয়। আমাদের আছে প্রতিভা, আছে স্বপ্ন। কিন্তু আমরা কি সেই প্রতিভাকে কাজে লাগাচ্ছি? আমরা কি ভোগ থেকে বেরিয়ে সৃষ্টির পথে হাঁটছি?
আমরা প্রায়ই দেখি—নতুন কোনো প্রযুক্তি বা সৃজনশীল ধারণা এলে আমরা ভোক্তা হিসেবে আগেভাগেই এগিয়ে যাই, কিন্তু উদ্ভাবক হিসেবে পিছিয়ে থাকি। এর পেছনে আছে আত্মবিশ্বাসের অভাব, ঐক্যের ঘাটতি আর সাহসের সংকট।
সম্ভাবনা শুরু হতে পারে ছোট্ট এক দোকান থেকে
ইতিহাস সাক্ষী—বিশ্বের অনেক বড় উদ্ভাবন জন্ম নিয়েছে গ্যারেজ থেকে, ছোট্ট কর্মশালা থেকে, কিংবা অতি সাধারণ পরিবেশে। তাহলে আমাদের ফুচকার দোকান থেকেও কেন জন্ম নিতে পারে না আগামী দিনের বিশ্বমানের প্রযুক্তি?
প্রয়োজন শুধু সঠিক মানসিকতা আর দৃঢ় পদক্ষেপ। প্রয়োজন উদ্ভাবনী চর্চাকে উৎসাহ দেওয়া, ব্যর্থতাকে ভয় না পাওয়া, আর একে অপরকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
হারা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা
মাসাহিরো হারা শুধু এক প্রযুক্তি দেননি, তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন এক দৃষ্টান্ত—যেখানে ব্যক্তিগত সম্পদের চাইতে মানবজাতির কল্যাণ বড়। QR কোডের গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, উদ্ভাবন তখনই মহান হয় যখন তা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।
তাহলে আমরা কেন পারব না? আমরা যদি নিজেদের সীমাবদ্ধতার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারি, তাহলে একদিন নিশ্চয়ই বাংলাদেশ থেকেও জন্ম নেবে এমন কোনো উদ্ভাবন, যা বদলে দেবে সমগ্র পৃথিবী।