বাংলাদেশের ছোট শহর, গ্রামের জীবনে মানুষ সাধারণত বাস্তববাদী হয়। ভূতের গল্প শোনে হাসে, বিশ্বাস করে না— আধুনিক যুগে এসব কৌতুকের মতো মনে হয়। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের মাঝিকাড়া গ্রামের মাষ্টার পাড়া এক ব্যতিক্রম। এখানে এখনো মানুষের মধ্যে একটা ভীতিকর আতঙ্ক কাজ করে— ভূতের ভয়ে এই পাড়ায় কেউ দীর্ঘ সময় বাস করতে চায় না।
ভূতের রহস্য নাকি মানুষের কল্পনা?
মাষ্টার পাড়ার নাম শুনলেই গ্রামের মানুষ অদ্ভুতভাবে সরিয়ে নেয় চোখ। অনেকেই নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য এলাকায় ভাড়া বাসা নিতে বাধ্য হন। এমনকি নতুন ভাড়াটিয়াদেরও এখানে থাকতে খুব একটা আগ্রহ নেই। পাড়ার অধিকাংশ বাড়ি এখন খালি ও পরিত্যক্ত।
স্থানীয়দের মত, এখানে নানা অদৃশ্য ঘটনা ঘটে। কেউ কেউ বলেন, ‘রাতের বেলা কোলাহল ছাড়া চারপাশ থমকে যায়। একা একা কথা বলা শোনা যায়, আবার অদ্ভুত আবেশে শিশুদের আচরণ বদলে যায়।’
কিছু মানুষের কথায়, এখানে জন্ম নেয়া প্রতিবন্ধী শিশুদের গল্পও রহস্য বাড়িয়ে দেয়। অল্প বয়সেই কিছু শিশু অজ্ঞাত কারণে মারা যায়। আবার কৌতূহল জাগায় চারপাশের বাড়ি থমকে থাকা, অদ্ভুত শব্দ, হঠাৎ দরজা খোলা বা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
ইতিহাসের ছাপ
মাষ্টার পাড়ার ইতিহাসও রহস্যময়। জানা যায়, গ্রামের ৯৯% বাসিন্দা ছিলেন হিন্দু ধর্মালম্বী। ১৯৪৭ সালের পর দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রভাবে অনেক পরিবার দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। যারা থাকতে চেয়েছিলেন, তাদের অনেককে উচ্ছেদ করা হয়।
এখানে ছিল কালি মন্দির, শিব মন্দির, যোগীদের কবরস্থান ও শ্মশান। বিভিন্ন সূত্রে মনে করা হয়, পুরনো সময়ে এই পাড়ায় ঘটে যাওয়া জোরপূর্বক উচ্ছেদ, মন্দির ধ্বংস এবং অনেকে নিহত হওয়ার ঘটনাগুলো পাড়ার মানুষকে আজও অদ্ভুতভাবে প্রভাবিত করছে।
স্থানীয়রা বলেন, হয়তো অতৃপ্ত মানুষের আত্মা এখনও এখানে রয়েছে, বা মা কালি, মহাদেব, কিংবা অন্য কোনো দেবতার বা জিনের উপস্থিতি এই রহস্যের জন্য দায়ী। আবার অনেকেই মনে করেন, সরু রাস্তা, নিরব পরিবেশ, ও দীর্ঘ সময় ধরে পরিত্যক্ত থাকার কারণে মানুষ ভূতের উপস্থিতি কল্পনা করতে পারে।
পাড়ার বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা
স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনের গল্প এই রহস্যকে আরও গভীর করেছে। সাবেক পুলিশ সার্জেন্ট মিজানুর রহমানের তিন ছেলের মধ্যে সবাই প্রতিবন্ধী ছিলেন। পরে তারা পার্শ্ববর্তী গ্রামে ভাড়া বাসায় চলে যান। মিঠু, টিটু, হাসান, তারেক নামে চার ভাই পৈতৃক বাড়িতে থাকতেন। কিছুদিন বসবাসের পর তারা বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যান।
সাবেক শিক্ষক শহীদুল ইসলাম বিএসসি মারা যান লঞ্চ দুর্ঘটনায়। তার স্ত্রী মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভাড়া বাসায় চলে যান। ভাড়াটিয়া সাদ্দাম হোসেন মিয়ার স্ত্রী বলেন, ‘এখানে থাকলে স্বামীর শরীর ঠিক থাকত না, তাই আমরা চলে এসেছি।’
বরিশাল থেকে আসা কাঠ ব্যবসায়ী হোসেন মিয়া বলেন, ‘আমার ৭ বছরের ছেলে মধ্যরাতে একা একা দরজা খুলে বের হয়ে যেত। সে কার সাথে কথা বলত, কেউ জানত না।’ এ সব ঘটনার মধ্য দিয়ে নতুন বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে ভাড়া ছেড়ে চলে যান। ফলে পাড়া এখন প্রায় নিস্তব্ধ, অনেক বাড়িই বন্ধ ও পরিত্যক্ত।
রহস্যের মিশ্রণ
মাষ্টার পাড়ার রহস্য শুধু ভূত নয়। এটি মানুষের ইতিহাস, উচ্ছেদ, নির্যাতন, মানসিক ও শারীরিক রোগ— সবকিছুর মিশ্রণ।
দীর্ঘ সময় পরিত্যক্ত বাড়ি,
রাতের অদ্ভুত শব্দ ও দরজা খোলার ঘটনা,
অজ্ঞাত কারণে রোগ বা অকাল মৃত্যু,
প্রতিবন্ধী শিশু ও অদ্ভুত আচরণ,
পরিবারের ভেতরের অশান্তি—
এই সব মিলিয়ে মানুষের মনে একটি অদৃশ্য ভয় তৈরি হয়। কেউ কেউ এটিকে ‘ভূতের আতঙ্ক’ বললেও, বাস্তবে এটির সঙ্গে ইতিহাস ও মানসিক প্রভাবও জড়িত।
বিজ্ঞান ও কৌতূহল
বেশির ভাগ ঘটনা বিজ্ঞানও ব্যাখ্যা করতে পারে। নিস্তব্ধ পরিবেশে শব্দ বড় মনে হয়। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত বাড়ি ও অন্ধকার জায়গায় মানুষের মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়। তবে কিছু ঘটনা কেবলই মানুষের কল্পনার সৃষ্টি, আবার কিছুটা সত্য— যেমন দরজা অজান্তে খোলা বা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
স্থানীয়রা জানায়, পাড়ায় এখনো একাধিক বাড়ি আছে, যেগুলোতে কেউ দীর্ঘসময় থাকে না। মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় ভোগা মানুষ এই এলাকাকে অস্বস্তিকর মনে করেন। কিন্তু একই সঙ্গে কৌতূহলও জাগে—মানুষ জানতে চায়, এই রহস্য সত্যি নাকি কল্পনা?
মজার কৌতূহল ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
মাষ্টার পাড়া এখন শুধু আতঙ্ক নয়, বরং স্থানীয়দের মজার গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। কেউ বলে, ‘রাতের বেলা কানে অদ্ভুত শব্দ আসে, তবে দেখতে গেলে কিছুই নেই।’ কেউ আবার হাস্যরসের সঙ্গে যুক্ত করে, ‘ভূত থাকলে হয়তো ভাড়াটিয়াদেরও মাসিক বিল নিতে পারে।’
এছাড়া নতুন প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও, ছবি এবং গল্প শেয়ার করে। পাড়ার রহস্য এখন কৌতূহল ও বিনোদনের একটি অংশ। যদিও অনেকে এটিকে বিশ্বাস করেন, অনেকে কেবল মজা করে দেখেন।
শেষ কথা
মাষ্টার পাড়া প্রমাণ করে, ইতিহাস, মানুষের কল্পনা এবং সামাজিক প্রভাব কিভাবে একত্রিত হয়ে রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করে। ভূতের গল্প কেবল কৌতুক নয়— এটি মানুষের ভয়, অতৃপ্তি, ইতিহাস ও মানসিক প্রভাবের প্রতিফলন।
বাংলাদেশে এমন এক জায়গা রয়েছে, যেখানে মানুষ আধুনিক যুগেও অদৃশ্য শক্তি ও ভূতের ভয়ে আতঙ্কিত। মাষ্টার পাড়া সেই জায়গা— যেখানে রহস্য, ইতিহাস এবং মানব মন একসঙ্গে মিলেছে।
যেখানে কেউ ভাড়ায় আসেন, তারা কিছুদিন থাকে, তারপর অদ্ভুত কারণে চলে যান। নতুন বাসিন্দারা কৌতূহল এবং ভয় দুটোই অনুভব করেন। ইতিহাস, মানসিক চাপ, রহস্যময় ঘটনাগুলো মিলিয়ে এই পাড়া আজও মানুষের কল্পনাকে চঞ্চল করে রাখে।
মাষ্টার পাড়া শুধু একটি গ্রাম নয়, এটি এক রহস্যময় ও মজার সামাজিক গবেষণার জায়গা। যেখানে ভূত, ইতিহাস, মানব আচরণ ও সামাজিক মনস্তত্ত্ব সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত রহস্য তৈরি করেছে।