মুর্শিদাবাদের খোশবাগ আজও নীরব…
নবাব সিরাজউদ্দৌলার কবরের পাশে কুয়াশায় ঢাকা এক সমাধি— তারই প্রিয়তমা স্ত্রী, বঙ্গসম্রাজ্ঞী বেগম লুৎফুন্নিসা। আজ ১০ নভেম্বর তার মৃত্যুবার্ষিকী। ইতিহাসের ধুলোমলিন পৃষ্ঠায় যার নাম অনেকটা হারিয়ে গেছে, কিন্তু যাঁর ভালোবাসা, সাহস আর ত্যাগের কাহিনি আজও বাঙালির স্মৃতিতে এক মৃদু সুরের মতো বাজে।
ভালোবাসা ও মর্যাদার প্রতীক
নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী বেগম লুৎফুন্নিসা ছিলেন এক বুদ্ধিমতী, সাহসী ও মানবিক নারী। নবাবের জীবনে যেমন তিনি ছিলেন ভালোবাসার প্রতীক, তেমনি ছিলেন পরামর্শদাতা, সঙ্গী এবং আশ্রয়। রাজপ্রাসাদের বিলাসের আড়ালে তিনি ছিলেন সাদাসিধে জীবনযাপনকারী— অন্যায় ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে নবাবকে দৃঢ় থাকতে বলতেন, মানুষকে সাহায্য করতেন নিঃশব্দে।
রাজপ্রাসাদের এক নীরব তরুণী
বলা হয়ে থাকে, মুর্শিদাবাদের রাজপ্রাসাদে জন্ম নেয়া লুৎফুন্নেসা ছিলেন সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা ও শালীনতার এক অপূর্ব সমন্বয়। তার সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার নিকাহ হয় খুব অল্প বয়সেই। তখন নবাব সিরাজ ছিলেন তরুণ, উদ্যমী, বাংলাকে নিয়ে স্বপ্ন ভিলাষী—আর লুৎফুন্নেসা ছিলেন তার নীরব কিন্তু দৃঢ় আশ্রয়।
রাজনীতির উত্তাল সময়েও ঘরের ভেতর এই নারী ছিলেন নবাবের স্থিরতা। ইতিহাসবিদরা বলেন, সিরাজ যখন ক্রমে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের জালে জড়াচ্ছিলেন, তখন একমাত্র লুৎফুন্নেসাই তাকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিতেন।
বিশ্লেষকের তাৎপর্যে বেগম লুৎফুন্নিসা
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. শেখ আকরাম আলী বেগম লুৎফুন্নিসা সম্পর্কে জানিয়েছেন যে, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী বেগম লুৎফুন্নিসা ছিলেন ইরাজ খানের কন্যা। ইরাজ খান ছিলেন আতি সম্ভ্রান্ত বংশীয়। লুৎফুন্নিসার আপন একজন ভাইও ছিলেন, নাম তার ইরান খান। ইরাজ খানের পিতা আকবর কুলি খান ভাগলপুরের শাসক ছিলেন। শাহজাদা আজমের মৃত্যুর পর তিনি বাংলায় চলে আসেন। আলিবর্দী খান বংশীয় মর্যাদার জন্য ইরাজ খানকে সম্মান দেখান এবং দরবারের উচ্চপদে নিয়োগ দেন। তিনি নিজেই ইরাজ খানের কাছে তার কন্যা লুৎফুন্নিসার জন্য সিরাজউদ্দৌলার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেন।’
ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে, বেগম লুৎফুন্নিসার জন্ম: ১৭৩৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, মৃত্যু: ১৭৮৬ সালের ১০ নভেম্বর।
তৎকালীন সরকারের ১৭৭৩ সালের ১৬ জুন তারিখের আদেশে দেখা যায়, নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী বেগম লুৎফুন্নিসার জন্য মাসিক ১০০০ টাকা ভাতা বরাদ্দ করা হয়। ১৭৮৬ সালে তার মৃত্যুর পর কোম্পানি সেই ভাতা বন্ধ করে দেয়।
যুদ্ধের পর এক নারীর নিঃসঙ্গতা
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ যখন বাংলার স্বাধীনতার স্বপ্ন ভেঙে দিল, তখন শুধু নবাব সিরাজই নিহত হলেন না— মৃত্যু হলো বেগম লুৎফুন্নিসার হাসিরও। প্রিয় স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি সমস্ত রাজকীয় জীবন ত্যাগ করে চলে যান মুর্শিদাবাদের খোশবাগে, নবাবের কবরের পাশে। সেখানেই শুরু হয় তার নতুন জীবন— ‘বেগম আম্মা’ নামে পরিচিত সেই বিধবা নারী দিন কাটাতেন অনাথ শিশুদের সেবায়, কোরআন তিলাওয়াতে, আর স্বামীর পদপাশে নীরবে প্রার্থনায়।
খোশবাগের আলোছায়ায়
ইতিহাস বলে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। সাদা পোশাকে, মুখে একটিমাত্র শান্ত হাসি, চোখে নীরবতা। মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে আমার প্রাণপ্রিয় স্বামী সিরাজউদ্দৌলার পদতলে সমাধি দিও— সেখানেই আমার স্বর্গ।’
আজ সেই সমাধি দুটি পাশাপাশি—একদিকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা, আরেকদিকে বেগম লুৎফুন্নিসা। বাতাসে ভেসে আসে শিউলি ফুলের গন্ধ, যেন প্রেম আর ত্যাগের চিরন্তন প্রতীক হয়ে বেঁচে আছেন তারা দুজনই।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার নবম রক্তধারা আব্বাসউদ্দৌলা আরেবের মতে, বেগম লুৎফুন্নিসা ছিলেন বাংলার ইতিহাসে এক বিরল নারী— যিনি বাংলার দুশমনদের চক্রান্তে রাজমর্যাদা হারিয়েও মানবিকতার মর্যাদা ধরে রেখেছিলেন। তিনি প্রমাণ করে গেছেন, ‘ভালোবাসা কেবল হৃদয়ের নয়, তা আত্মারও অনন্ত প্রতিশ্রুতি।’
আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে ইতিহাস যেন শ্রদ্ধা ভালোবাসায় তাকে সালাম জানায়— যিনি ছিলেন বাংলার অমর প্রেমের প্রতীক, ত্যাগের চিহ্ন, আর এক নিঃশব্দ বীর নারী।
ভালোবাসা ও হারানোর উত্তরাধিকার
বেগম লুৎফুন্নেসা আজ ইতিহাসের প্রান্তে এক অস্পষ্ট নাম। অথচ তার জীবনই যেন এক প্রতীক—এক নারীর নীরব শক্তি, যার ভালোবাসা ইতিহাসের পাতায় না থাকলেও সময়ের স্মৃতিতে অমলিন। যে প্রাসাদে একসময় সোনার ঝলকানি, রেশমি পর্দার দোলায় তিনি হেঁটেছিলেন, আজ সেখানে ইতিহাসের ধুলা। কিন্তু সেই ধুলার ভেতরেও লুৎফুন্নেসার মমতাময় মুখ যেন ভেসে ওঠে— একজন সৎ আদর্শবান স্ত্রীর, একজন প্রেয়সীর, একজন নারীর চিরন্তন প্রতিচ্ছবি হয়ে।