Thursday 13 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নীল ময়ূর: পাখিদের রাজ্যের এক নীল রত্ন

মো. ওবায়দুল বারী খান
১৩ নভেম্বর ২০২৫ ১৬:১৩

পশু-পাখির সাথে সময় কাটানো আমার ভীষণ পছন্দের কাজ।কর্মক্ষত্রের সুবাদে পছন্দের কাজটি করার বড় একটি সুযোগ এসে যায়। গতবছর বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার জ্যু অফিসার পদে যোগদান করি। প্রতিদিন সকাল সকাল অফিস কক্ষ থেকে পাখির কলকাকলি শুনতে অন্যরকম এক ভালো লাগা কাজ করে। আমার কক্ষের ঠিক সামনেই রয়েছে চোখার, রাজধনেশ, সবুজ ঘুঘু ও নীল ময়ূর-এর এনক্লোজার। এরা আমার নিকটতম প্রতিবেশী। সেজন্য এই চার প্রজাতির পাখিকে একটু বেশি সময় দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত পছন্দের পাশাপাশি চাকুরি জনিত কারণেও নীল ময়ূর নিয়ে একটু বেশি মনোযোগ দিতে হয়। কেননা, প্রজননের আধিক্য ও মানুষের প্রচুর চাহিদার কারণে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা হতে প্রতি পিস ময়ুর ২৫,০০০/- করে বিক্রয় করা হয়ে থাকে। সারাদিন ওদের সান্নিধ্যে সময় কাটানোর প্রভাবে নিকটতম প্রতিবেশী বন্ধু ও রাজকীয় পাখি নীল ময়ূর সম্পর্কে কিছু লিখার ইচ্ছে জাগ্রত হলো।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার নীল ময়ূর বলতে মূলত বোঝায় ভারতীয় নীল ময়ূর, যার বৈজ্ঞানিক বা দ্বিপদ নাম হলো pavo cristatus (এটি আমাদের দেশে ময়ূর নামেও পরিচিত)। যদিও নীল ময়ূরের উৎপত্তি ভারতীয় উপমহাদেশে, তবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন শ্রীলংকা,বাংলাদেশ, মায়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় এর পরিচিত ও বিস্তৃতি রয়েছে। নীল ময়ূর আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের জাতীয় পাখি। প্রকৃতিতে বসবাসের জন্য তাদের মৌলিক প্রয়োজনীয়তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হলো একটি উপযুক্ত বাসস্থান। বসবাসের জন্য ঘন বনভূমি এরা পছন্দ করে, সেখানে তারা উঁচু গাছের ডাল-পালা বেছে নেয়। ময়ূরের এই প্রজাতিটি যেকোনো আবহাওয়ায় সহজে মানিয়ে চলতে সক্ষম। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা, মিরপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় এদের রাখা হয় এবং ক্যাপটিভ ব্রিডিং করানো হয়। তাছাড়া, দেশের বিভিন্ন রিসোর্টেও নীল ময়ূর পালন করা হয়ে থাকে। দেখতে আকর্ষণীয় হওয়ায় বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের কাছে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দেশের অনেক মানুষ রয়েছেন, যারা শৌখিনভাবে বাড়ির উঠোন বা ছাদে নীল ময়ূর পালন করে থাকেন।

আকার এবং রঙ এর মাধ্যমে পুরূষ ও স্ত্রী ময়ূরের পার্থক্য সনাক্ত করা সম্ভব। একটি পুরুষ ময়ূরের ঠোঁট থেকে লেজের দৈর্ঘ্য গড়ে ১০০-১২০ সেমি (৪০-৪৬ ইঞ্চি) এবং পূর্ণ বয়স্ক ট্রেনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ২০০-২৩০ সেমি (৭৮-৯০ ইঞ্চি) পর্যন্ত। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এর গড় ওজন ৪-৫ কেজি। ‘ট্রেন’ আসলে ময়ূরের লেজ নয়।পুরুষ ময়ূরের দেহের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো ট্রেন বা তার বর্ণিল পালক। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ময়ূরে ‘ট্রেন’ ২০০ টিরও বেশি ‘আপার টেইল কাভার্ট’ পালক দিয়ে গঠিত হয়ে থাকে।এটি লেজের উপরের দিক থেকে গজায় এবং আসল লেজকে ঢেকে রাখে। এই পালকগুলো ঝলমলে রঙের হয় এবং এর ওপরে থাকে চোখের মতো নকশা, যেগুলোকে বলা হয় ‘ওসেলি’। পুরুষ পাখির মাথায় সুন্দর সবুজ ও নীল রঙের পালকের একটি উজ্বল মুকুট থাকে। একে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ক্রেস্ট’বা ‘ক্রাউন’।ট্রেন ও ক্রেস্টের মাধ্যমে পুরুষ ময়ূর স্ত্রী ময়ূরকে আকর্ষণ করে থাকে। পুরুষ ময়ূরের পায়ের পিছনের আঙুলের উপর প্রায় ২.৫ সেমি লম্বা একটি স্পার থাকে; প্রজনন ঋতুতে পুরুষ পাখিরা অন্যান্য প্রতিযোগী পুরুষ পাখিদের তাড়াতে এগুলো ব্যবহার করে। পুরুষ ময়ূরের ট্রেনের পালক এবং টারসাল স্পার তার জীবনের দ্বিতীয় বছরেই বিকশিত হতে শুরু করে। ট্রেনগুলি চার বছর বয়স পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয় না। পুরুষ ময়ূরের ট্রেনের পালকগুলিও প্রতি বছর পড়ে যায়, যাকে বলা হয় মোল্টিং। মোল্টিং সাধারণত আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে শুরু হয় এবং ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়।অর্থাৎ প্রজনন সময় শেষে মোল্টিং শুরু হয়।

স্ত্রী ময়ূর আকারে কিছুটা ছোট, দৈর্ঘ্যে প্রায় গড়ে ৩৮ সেমি (১৫ ইঞ্চি) এবং গড় ওজন ২.৫-৪ কেজি। স্ত্রী পাখিরা সাধারণত হালকা হলুদ থেকে বাদামী, ধূসর এবং ক্রিম রঙের হয়। স্ত্রী পাখির মাথায়ও মুকুট থাকে, তবে তা ছোট ও কম উজ্বল। মাথার তথা দেহের উপরের অংশ বাদামী বর্ণের হয়। বুক, পেট-এর অংশ এবং ডানার পালকে ফ্যাকাশে রঙের ছোপ ছোপ দাগযুক্ত নকশা (বাদামী ও কালচে) দেখা যায়।

নীল ময়ূর (১.৩-১.৫বছর) বয়সে প্রজননক্ষম হয়। এদের প্রজননকাল ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত। এ সময় এরা প্রচুর ডাকাডাকি করে থাকে। প্রজননের সময় একটি স্ত্রী ময়ূর ১০-১৫ টি ডিম পাড়ে। ডিম হতে বাচ্চা ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩২ দিন।প্রজনন ঋতুতে পুরুষরা তাদের অঞ্চল রক্ষা করে। একটি একক পুরুষ ময়ূরের একটি হারেম (৮-১০ টি স্ত্রী ময়ূর) থাকতে পারে।

নীল ময়ূর সর্বভূক পাখি। এরা বিষাক্ত সাপ, টিকটিকি এবং পোকামাকড় খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে একটি স্থিতিশীল বাস্তুতন্ত্র বজায় রাখতে সাহায্য করে। প্রকৃতিতে চারা গাছের অংশ, শস্য দানা, পোকামাকড়, ফুলের পাপড়ি, ফলমূল, শাক-সবজি ও ছোট ছোট সন্ধিপদ প্রাণি এদের প্রিয় খাবার। বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় নীল ময়ুরকে খাবার হিসেবে পোল্ট্রিফিড, চিনাবাদাম, শাক, সিদ্ধ ডিম, ফলমূল, ভিটামিন প্রিমিক্স খাওয়ানো হয়। এখানে এদেরকে প্রতি তিন মাস পর পর কৃমিনাশক ওষুধ দেওয়া হয়। এছাড়া বছরে একবার এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা ও শিডিউল অনুযায়ী রাণীক্ষেতের টিকা দেওয়া হয়ে থাকে। বন্য পরিবেশে নীল ময়ূর ১৫-২০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। তবে, বন্দী অবস্থায় বা চিড়িয়াখানায় এদের আয়ুষ্কাল ২২-২৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে। আইইউসিএন অনুসারে,নীল ময়ূর বাংলাদেশে বন্য পরিবেশে অনুপস্থিত বলে বিবেচিত হয়।

লেখক: জ্যু অফিসার, বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা, মিরপুর

সারাবাংলা/ইএইচটি/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর