Monday 17 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মোমবাতির ‘অ্যালার্ম ঘড়ি’: টুং শব্দে জেগে ওঠার পুরোনো দিনের চমৎকার কৌশল

ফারহানা নীলা
১৭ নভেম্বর ২০২৫ ১৬:৪৪

মানুষের ঘুম ভাঙানোর ইতিহাস বেশ মজার। আজ আমরা যে ডিজিটাল অ্যালার্ম ঘড়ির উপর পুরোপুরি নির্ভর করি, তার আগেও মানুষ সঠিক সময়ে জেগে ওঠার জন্য অবলম্বন করত নানান বুদ্ধি ও লোককৌশল। সেই তালিকায় সবচেয়ে অভিনব ও মজার পদ্ধতিগুলোর একটি হলো— মোমবাতির গায়ে পেরেক লাগিয়ে রাখা ‘টাইমড ক্যান্ডেল অ্যালার্ম’। এটি দেখলে মনে হবে পুরোনো দিনের কোনো বিজ্ঞানী বা কারিগরের বুদ্ধিদীপ্ত ছোট্ট আবিষ্কার। কিন্তু এই মোমবাতির কৌশল বহু দেশে বহু শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হয়েছে।

কীভাবে কাজ করতো এই মোমবাতি অ্যালার্ম?

পদ্ধতিটা ছিল মোটেই কঠিন নয়। আগে থেকেই জানা থাকত একটি নির্দিষ্ট সাইজের মোমবাতি এক ঘণ্টায় কতটা গলে। সেই হিসেব অনুযায়ী মোমবাতির গায়ে একটি ছোট পেরেক কিংবা ধাতব খাঁটি বসিয়ে দেওয়া হতো। যখন রাতের বেলায় মানুষ ঘুমাতে যেত, তখন মোমবাতি জ্বালিয়ে পেরেকের ঠিক নিচে একটি লোহার বা তামার পাত্র রেখে দিত।

বিজ্ঞাপন

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মোম গলতে থাকত। নির্দিষ্ট সময়ে আগুন মোম গলিয়ে ফেললে পেরেকটি আলগা হয়ে নিচে পড়ে টুং করে শব্দ হতো। আর এই ধাতব শব্দই ছিল সেই সময়ের নিখুঁত অ্যালার্ম! কোনো বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করা লাগত না, ব্যাটারি ডাউন হওয়ার ভয়ও ছিল না—মোমবাতি জ্বললেই হলো।

প্রাচীন ‘টাইম ম্যানেজমেন্ট’— একদম ভিন্ন মাত্রায়

এ ধরনের মোমবাতিকে বলা হতো candle clocks বা মোমবাতি ঘড়ি। মধ্যযুগে ইউরোপের সন্ন্যাসীরা রাতের প্রার্থনার সময় ঠিক রাখতে এমন মোমবাতি ব্যবহার করতেন। কেউ কেউ আবার দিনে কাজের বিরতি বা রান্নার সময় মাপার জন্যও এটি ব্যবহার করতেন। অনেক সময় মোমবাতিতে একাধিক পেরেক গেঁথে দেওয়া হতো, যেন একেক সময়ে একেকটি সতর্কবার্তা পাওয়া যায়। অর্থাৎ, বহু শিফটের অ্যালার্ম—একেবারে আধুনিক মাল্টি-অ্যালার্ম ফিচারের পূর্বসূরি!

মজার বিষয় হলো, ধনী পরিবারগুলো বিশেষভাবে তৈরি করা ঘন্টার মতো মোমবাতি ব্যবহার করত। মোমবাতির ভিতরে বাড়তি ধাতব টুকরো লাগানো থাকত, যা পড়ার মুহূর্তে আরও জোরে শব্দ করত। কেউ কেউ আবার পেরেকের বদলে ধাতব রিং ব্যবহার করত, যা পড়ার সময় টুং-এর বদলে টিং-টিং করে একটু সংগীতধর্মী সুর তুলত।

ঝামেলাও ছিল, গল্পও ছিল

যদিও এই পদ্ধতি যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল, তবে মোমবাতি ‘অ্যালার্ম’ ব্যবহারে ছোটখাটো ঝামেলাও হতো। যেমন— বাতাসের টোকা লাগলে মোমবাতি নিভে যেতে পারে, আবার গলে যেতে কতক্ষণ লাগবে তা পরিবেশের তাপমাত্রার উপরেও নির্ভর করত। ঠান্ডায় মোম শক্ত থাকলে ধীরে গলতো, গরমে বেশি দ্রুত। ফলে কখনো কখনো অ্যালার্ম একটু আগে বা পরে বাজে— যা আধুনিক মানুষের কাছে সফটওয়্যার বাগের মতোই বিরক্তিকর।

কিন্তু তখনকার মানুষের কাছে এটাই ছিল নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। আর কৌতুহলী শিশুরা মাঝেমাঝেই চুপিসারে পেরেকের জায়গা বদলে দিয়ে বাবা-মায়ের অ্যালার্ম একটু আগেই বাজিয়ে দিত— একেবারে সেই সময়ের ‘প্র্যাঙ্ক কালচার’!

মোমবাতির অ্যালার্ম: অতীতের সরল সৌন্দর্য

আজকের ইলেকট্রনিক অ্যালার্ম আমাদের জীবন সহজ করেছে ঠিকই, কিন্তু মোমবাতি অ্যালার্মের মধ্যে যে সরলতা আর সৃজনশীলতা ছিল, তা অনন্য। কোনো ব্যাটারি নেই, কোনো স্ক্রিন নেই—এখনকার মিনিমাল লাইফস্টাইল ট্রেন্ডের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে যায়!

মজার ব্যাপার হলো, আজও কেউ কেউ পুরোনো দিনের এই পদ্ধতি সংগ্রহ বা পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করেন। ছোট্ট একটি পেরেক, কিছু মোম আর আগুন— এই তিনের মিলনে তৈরি হয় মানুষের জেগে ওঠার ইতিহাসের এক বর্ণিল অধ্যায়।

এভাবেই একটি সাধারণ মোমবাতি একসময় ছিল ঘড়ি, ছিল অ্যালার্ম—আর ছিল মানুষের নির্ভরতার চিরচেনা সঙ্গী।

সারাবাংলা/এফএন/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর