বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাত শুধু দুধ-মাংস উৎপাদনের ওপরই সীমাবদ্ধ নয়; দেশের পুষ্টি, কৃষক পরিবারের জীবিকা ও সামগ্রিক জাতীয় অর্থনীতিও এ খাতের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। কিন্তু এই সম্ভাবনাময় খাতকে নীরবে আঘাত করে যাচ্ছে একটি ভয়ংকর জুনোটিক রোগ-বোভাইন টিউবার কুলোসিস (bTB)।
গবাদিপশু থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা থাকায় এটি এখন বৈশ্বিকভাবে ‘পাবলিক হেলথ থ্রেট’ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করা আরও জরুরি, কারণ এখানে পশুর ঘনত্ব বেশি, রোগ নির্ণয় সুবিধা সীমিত, আর সচেতনতার ঘাটতিও প্রকট। মূলত গবাদিপশুর মধ্যে ছড়ালেও এই রোগে মানুষও আক্রান্ত হতে পারে । ফলে এটি শুধু পশুর স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়,বরং মানব স্বাস্থ্য, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং পশুপালন ভিত্তিক পরিবারের জীবিকাকেও উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।এই লেখায় bTB-এর প্রকৃতি, সংক্রমণ, দেশে সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি, সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব ও প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সমূহ তুলে ধরা হলো।
বোভাইন টিউবারকুলোসিস কী এবং কেন এটি ভয়ংকর?
bTB হলো Mycobacterium bovis ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট সংক্রমণ, যা গবাদি পশুর ফুসফুস, লিম্ফ নোড লিভার সহ বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত করে। আক্রান্ত পশুতে সাধারণত দেখা যায়:দীর্ঘমেয়াদি কাশি,দুধ উৎপাদন কমে যাওয়া,ওজন হ্রাস,দুর্বলতা ও কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া। মানুষের ক্ষেত্রেও এই ব্যাকটেরিয়া ফুসফুস, হাড়, গলার টিস্যু এবং পাচনতন্ত্র আক্রান্ত করতে পারে। অনেক সময় উপসর্গ অস্পষ্ট থাকায় রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব ঘটে। শিশু, বয়স্ক এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা ব্যক্তিরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
সংক্রমণ ও ঝুঁকি
bTB একটি গুরুত্বপূর্ণ জুনোটিক রোগ। প্রাণি থেকে মানুষের মধ্যে এটি ছড়ায় মূলত তিনটি উপায়ে:
১. কাঁচা দুধ বা অপর্যাপ্ত সিদ্ধ মাংস খাওয়া:
গ্রামীণ এলাকায় এখনও অনেক জায়গায় কাঁচা বা অপরিশোধিত দুধ সরাসরি সেবন করা হয়। এটি সংক্রমণের প্রধান উৎস।
২. আক্রান্ত পশুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ:
খামার শ্রমিক, পশু পালনকারী, দুধ সংগ্রহকারী,প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মী এবং মাংস প্রক্রিয়াজাতকারীগণ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
৩. কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি না মেনে নতুন কেনা পশুর খামারে প্রবেশ করানো
৪. দুর্বল খামার ব্যবস্তাপনা এবং অপর্যাপ্ত বায়োসিকিউরিটি।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, দেশে গবাদিপশুর মধ্যে bTB-এর প্রাদুর্ভাব ২–১২%। ।বেশিরভাগ খামারে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় না। পরিচ্ছন্নতা,বায়ু চলাচল ও ব্যবস্থাপনায় বড় ঘাটতি রয়েছে।নতুন পশু কেনার আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার কোনও বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া, কাঁচা দুধ ও অপর্যাপ্ত সিদ্ধ মাংস খাওয়া্র মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় রোগটি ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করেছে ।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
bTB কেবল স্বাস্থ্যগত নয়, এটি একটি বড় অর্থনৈতিক সংকটও তৈরি করছে ।দুধ উৎপাদন ২০–৩০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে,খামারের আয় হ্রাস পায়,মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বাড়ে,শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা কমে যায়,খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির মান ঝুঁকিতে পড়ে,আক্রান্ত প্রাণি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই বিক্রি করার কারণে অন্য খামারেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে, যা একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে ।
bTB নিয়ন্ত্রণে ওয়ান হেলথ এপ্রোচ
জুনোটিক রোগ নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে সবচেয়ে কার্যকর ধারণা হলো ওয়ান হেলথ—যেখানে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্যকে একসঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়।এর সুবিধা হলো, এখানে প্রাণিসম্পদ বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং পরিবেশ বিভাগ একযোগে কাজ করতে পারে।ফলে নজরদারি, রোগ সনাক্তকরণ ও প্রতিরোধ অনেক সহজ হয়।জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।bTB প্রতিরোধে এই সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
bTB প্রতিরোধে করণীয়
খামার পর্যায়ে:
১.সকল পশুকে অন্তত বছরে একবার টিউবারকুলিন স্কিন টেস্টের আওতায় এনে bTB পরীক্ষা সম্পন্ন করা,
২. নতুন কিনে আনা নতুন আনা পশুর bTB পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা,
৩. গোয়ালঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা,পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ব্যবস্থাসহ পর্যাপ্ত বায়োসিকিউরিটি নিশ্চিত করা,
৪. আক্রান্ত প্রাণী আলাদা রাখা ও চিকিৎসা প্রদান,
৫. দুধ ও মাংস সম্পূর্ণ সিদ্ধ করে সেবন করা,
৬. ল্যাব, পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষাকালীন সময়ে খামারে ও কসাইখানায় গ্লাভস, মাস্কসহ সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার,
৭. নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি।
সরকারের করণীয়
১. bTB নিয়ন্ত্রণে ওয়ান হেলথ এপ্রোচ বাস্তবায়ন,
২. জাতীয় bTB নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চালুকরণ,
৩. পর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা প্রতিষ্ঠা ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরিকরণ,
৪. আক্রান্ত পশুর জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা,
৪. কৃষক ও খামারিদের সম্পৃক্ত করে জনসচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণ,
৫. টেকসই সমাধানের জন্য সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় অপরিহার্য।
উপসংহার
বোভাইন টিউবারকুলোসিস একটি “সাইলেন্ট থ্রেট”— যা একইসঙ্গে মানুষের জীবন, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের আয় এবং জাতীয় অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। সঠিক সময়ে ব্যবস্থা না নিলে এই নীরব হুমকি আরও বড় আকার ধারণ করতে পারে।তাই এখনই প্রয়োজন— ওয়ান হেলথভিত্তিক সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সচেতনতা বৃদ্ধি ও কঠোর বায়োসিকিউরিটি।গবাদিপশুর সুস্থতা মানেই দেশের পুষ্টি, অর্থনীতি ও মানবস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।বাংলাদেশের উন্নয়নধারাকে টিকিয়ে রাখতে bTB নিয়ন্ত্রণ আজ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
ঢাকা: প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার, ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ সেকশন, প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (LRI), মহাখালি, ঢাকা