১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নামের জন্ম হয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। পরিবারের কাছের মানুষরা তাকে ডাকতেন ‘পিনো’ নামে— একদম ব্যক্তিগত, কোমল এক পরিচয়। কিন্তু সময় তাকে শুধু রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে নয়, বরং আলাদা ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ বছর তার ৬০তম জন্মদিন।
শৈশব: রাজনৈতিক পরিবারের ক্রমশ গড়ে ওঠা এক উত্তরসূরি
জন্ম থেকেই রাজনীতি তার চারপাশে। রাষ্ট্রপতি ভবনের দৈনন্দিন ব্যস্ততা, মায়ের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, সেনানিবাসের কঠোর শৃঙ্খলা—সব মিলিয়ে ছোটবেলার পরিবেশটাই ছিল নেতৃত্ব শেখার এক স্কুল। বলা হয়ে থাকে, তারেক রহমান ছিলেন শান্ত, পর্যবেক্ষণক্ষম এবং সংবেদনশীল স্বভাবের। সেন্ট জোসেফ কলেজ, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে মাধ্যমিক; এরপর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক— ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলা ও সহনশীলতার শিক্ষা পেয়েছেন প্রবলভাবে।

১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন— প্রথমে আইন বিভাগে, পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। রাজনীতিতে না এলেও, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ক্ষমতার আচরণ সম্পর্কে তার আগ্রহ তখন থেকেই গড়ে উঠছিল।
পিতৃহারা কিশোর থেকে দৃঢ় রাজনীতিকের পথে
১৯৮১ সালের ৩০ মে। চট্টগ্রামে বিদ্রোহী সেনাদের গুলিতে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। সংবাদটি যেদিন ঢাকায় পৌঁছায়, মাত্র ১৩ বছরের তারেক রহমান কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। সেই কান্নার সঙ্গে কান্না মিলিয়েছিল পুরো দেশ। মৃত্যুর সেই ধাক্কা যেন তার জীবনে এক নতুন বোঝাপড়া আনে—মানুষের আবেগ, সংগ্রাম এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দায়বোধ তিনি তখন থেকেই বুঝতে শুরু করেন।
রাজনৈতিক পথচলার শুরু: বগুড়া থেকে জাতীয় নেতৃত্বে
২২ বছর বয়স। ১৯৮৮ সাল। নিজের জন্মভূমি বগুড়ার গাবতলী থানা বিএনপিতে একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে রাজনীতির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু তারেক রহমানের। এটা অন্যরকম হাতেখড়ি। কেউ তাকে পেছন থেকে সুপারিশ করেননি। বরং, তিনি বেছে নেন বগুড়া— গ্রামীণ জনজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তুলতে।
১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে বিজয়ী হলে, সেই আসনগুলোতে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন তরুণ তারেক। তিনি উন্নয়ন, তৃণমূল যোগাযোগ ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। দলের ভেতরে তখনই ছড়িয়ে পড়ে তার সাংগঠনিক দক্ষতার খ্যাতি। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে-পরে দলীয় কর্মকাণ্ডে তারেক রহমান হয়ে ওঠেন এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু। বনানীর অফিসে তিনি গড়ে তোলেন গবেষণাধর্মী নতুন রাজনৈতিক কাঠামো, যেটি ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভূমিকার কেন্দ্রে পরিণত হয়। ২০০২ সালে তিনি দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব হন। শুরু করেন দেশব্যাপী সাংগঠনিক পুনর্গঠনের যাত্রা— যার মাধ্যমে ৭০ হাজার গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিএনপির সংগঠন নতুন প্রাণ পায়।

গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে শহর, জেলা, বিভাগ—সব জায়গায় তার উপস্থিতি যেন নতুন ধরনের গণতান্ত্রিক সংগঠনচর্চা তৈরি করছিল। ইউনিয়ন প্রতিনিধি সম্মেলনে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা নিজের কথা বলছিলেন সামনে দাঁড়িয়ে, আর তিনি শুনছিলেন মনোযোগ দিয়ে। অনেকেই বলতেন, তার চোখে জিয়াউর রহমানের ছায়া দেখা যায়।
২০০৭-এর সময়কাল: জেল, চিকিৎসা ও লন্ডনে নতুন অধ্যায়
১/১১ সরকারের সময়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে চিকিৎসার প্রয়োজনে তিনি লন্ডনে যান এবং ২০০৮ সাল থেকে সপরিবারে সেখানে বসবাস করছেন। এই দীর্ঘ বিদেশবাস অনেকের কাছে এক ধরনের রাজনৈতিক নির্বাসন মনে হলেও, দলীয় সিদ্ধান্তে তিনি এখনো কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি বিএনপির বৃহত্তর সিদ্ধান্তগুলো দেন নিয়মিত। প্রবাসে থেকেও বিভিন্ন সভা, বৈঠক এবং দলের নীতিনির্ধারণী আলোচনায় সক্রিয় তিনি। দলীয় নেতারা বলেন, “তারেক রহমান বাইরে থাকলেও দেশের রাজনীতি নিয়ে তার ফোকাস এক মুহূর্তও নড়ে না।”
এবারের জন্মদিনে কেক বা ব্যানার নয় , আছে নীরব শ্রদ্ধা
তারেক রহমানের ৬০তম জন্মদিনকে কেন্দ্র করে বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে কেক কাটা, পোস্টার লাগানো, আলোচনা সভা বা ব্যানার টানানো থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। এ নির্দেশনা এসেছে সরাসরি তারেক রহমানের কাছ থেকেই। বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি চান না জন্মদিন ঘিরে কোনো ভুল বার্তা যাক। তাই দল নীরব, সংযত, দায়িত্বশীল আয়োজন বেছে নিয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক শুভেচ্ছা বার্তায় বলেন— “তারেক রহমান আজ শুধু বিএনপির নয়, দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতেরও প্রতিনিধি। আমরা তার সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু এবং দ্রুত দেশে ফেরার অপেক্ষায়।”
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন— “তিনি নিজেই চাইছেন অত্যন্ত সংযত ও শান্তভাবে দিনটি পালিত হোক। নেতা হিসেবে তাঁর এই মনোভাব আমাদের অনুপ্রাণিত করে।”
ফেরার প্রত্যাশা: দল থেকে তৃণমূল—সবার মনে একটাই প্রশ্ন
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন, ছাত্র-জনতার নতুন আন্দোলন এবং সাংগঠনিক পুনর্গঠন— সব মিলিয়ে একটি সাধারণ প্রশ্ন আজ ঘুরে বেড়াচ্ছে বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে— “তারেক রহমান কি শিগগিরই দেশে ফিরছেন?”

দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা ইঙ্গিত দিয়েছেন, পরিস্থিতি এখন বদলাচ্ছে, এবং তারেক রহমানের ফিরতে আর বেশি সময় লাগবে না। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “দেশ পরিবর্তনের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এ সময়ে তারেক রহমানের নেতৃত্ব প্রয়োজন। অবশ্যই তারেক রহমান ফিরবেন। দেশ এবং গণতন্ত্রের জন্য কাজ করবেন।”
তৃণমূলের কর্মীরাও একই সুরে বলেন, “উনি এলে দল আরও শক্তিশালী হবে। আমরা অপেক্ষায় আছি।”
একটি জন্মদিন, এক নীরব প্রত্যাশা
তারেক রহমান আজ ব্যক্তিগত জীবনে ৬০-এ পা দিলেন। দলের ভেতরে আশা, দেশজুড়ে জল্পনা— সব মিলিয়ে তার এই জন্মদিন যেন এক ধরনের প্রতীকী বার্তা বহন করছে: নতুন রাজনীতি, নতুন বাংলাদেশ, এবং সম্ভবত নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
কবে ফিরবেন তিনি?
উত্তর এখনো সময়ের কাছে। তবে অপেক্ষা— এখনই সবচেয়ে শক্তিশালী সঙ্গী।
লেখক: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা ডটনেট