Thursday 20 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সবুজ ঘুঘু: বনভূমির নীরব অতিথি

মো. ওবায়দুল বারী খান
২০ নভেম্বর ২০২৫ ১৬:০০

বাংলার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য যত রঙিন, ততই চমৎকার ও বৈচিত্র্যময় এর পাখিপ্রাণ। সেই রত্নভাণ্ডারের এক শান্ত-স্বভাব, লাজুক অথচ নজরকাড়া রংধনু হলো- সবুজ ঘুঘু। কিছু জায়গায় একে ‘বাঁশঘুঘু’ বা ‘পাতি শ্যামা ঘুঘু’ নামেও ডাকা হয়। এর ইংরেজি নাম Common Emerald Dove এবং বৈজ্ঞানিক নাম Chalcophaps indica। নরম ও শান্ত স্বভাবের এই পাখিটিকে নিয়ে লিখছি আজকের ফিচার।

রূপে-গুণে আলাদা

সবুজ ঘুঘুকে প্রথম দেখলে মনে হয় যেন পান্না সবুজ রঙের কোনো শিল্পীর তুলির আঁচড়। শরীরজুড়ে গাঢ় সবুজ পালকের ওপর ধাতব ঝলক, গলা ও মাথার অংশে ধূসরাভ আভা-সব মিলিয়ে জমকালো এক উপস্থিতি। চোখ দুটো উজ্জ্বল, আর ঠোঁট ছুঁই ছুঁই করা হালকা হলদে রঙ। ডানার বিস্তার মাঝারি হলেও উড়তে বেশ সক্ষম, শব্দহীন ডানার ঝাপটায় আনায়সেই বনজুড়ে পথ চলে। সবুজ ঘুঘু আকারে সাধারণত ২০-৩০ সেমি হয়ে থাকে। এদের ওজন ১৩০-১৩৫ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। পুরুষ পাখির মাথা, ঘাড় ও বুকের সামনের অংশে হালকা ধূসর/হালকা গোলাপী রঙের আভা দেখা যায়, যা স্ত্রী পাখিতে থাকে না। পুরুষ পাখির কাঁধের প্রান্তে একটি সাদা দাগ থাকে , যা স্ত্রী পাখির থাকে না।

বিজ্ঞাপন

বাসস্থান ও বিস্তার

সবুজ ঘুঘুর প্রধান আবাসস্থল হলো উপকূলীয় বন, পাহাড়ি অরণ্য এবং পুরনো বৃক্ষসমৃদ্ধ অঞ্চল। ছায়াযুক্ত স্থান এরা পছন্দ করে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারত, মিয়ানমার, নেপালসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঘন বনাঞ্চলে এদের দেখা মেলে। বাংলার গ্রাম থেকে শুরু করে জঙ্গল, বাঁশঝাড়, পাহাড়ি বনে নানা জায়গায় দেখা মিললেও পাখিটি এতটাই নীরব ও নির্জনপ্রীত যে সাধারণ মানুষের চোখে খুব কমই পড়ে। বাংলাদেশের সুন্দরবন, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ী বনাঞ্চল, দেশের বিভিন্ন রিজার্ভ বন এই পাখির প্রজনন ও বিচরণের আদর্শ স্থান। ঢাকা শহরের মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে অনেক সময় এদের দেখা মেলে। তাছাড়া মিরপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় সবুজ ঘুঘু সংরক্ষিত রয়েছে।

খাদ্যাভ্যাস

এই পাখির খাবার মূলত বিভিন্ন ধরনের বনজ ছোট ফল সমূহ। প্রায়শই এরা মাটিতে পড়ে থাকা ফলের সন্ধান করে। এদের খাওয়ার ধরন প্রকৃতির জন্য উপকারীও বটে; ফলসহ বীজ খেয়ে দূরে গিয়ে মলত্যাগের মাধ্যমে তারা বনের বৃক্ষবিস্তারেও ভূমিকা রাখে।

স্বভাবে শান্ত, আচরণে সতর্ক

সবুজ ঘুঘু মানুষকে এড়িয়ে চলতে ভালোবাসে। অতি শব্দহীন তবু সতর্ক আচরণই তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাধারণত একা বা জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। প্রজনন মৌসুমে তারা বেশ সংযত আচরণ করে; গাছের উঁচু ডালে পাতা-ডালের মাধ্যমে সরল নীড় তৈরি করে।

প্রজনন

সবুজ ঘুঘুর প্রজনন সাধারনত গ্রীষ্মকাল ও বর্ষাকালে হয়, বিশেষত মে থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে। স্ত্রী পাখি বছরে এক থেকে দুইটি ডিম দিয়ে থাকে, মা-বাবা উভয়েই সেগুলোর যত্ন নেয়। ডিমের রং সাদা বা হালকা সবুজাভ হয়ে থাকে। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে ১২-১৫ দিন সময় লাগে। বাচ্চাগুলো সাধারণত ৩-৪ সপ্তাহে বাসা ছাড়ে।

সংরক্ষণে মনোযোগ জরুরি

বনভূমির নীরব পরিবেশে তাদের উপস্থিতি এক স্বস্তিদায়ক সৌন্দর্য যোগ করে। যদিও আন্তর্জাতিকভাবে সবুজ ঘুঘুকে এখনও বিপন্ন তালিকায় রাখা হয়নি, কিন্তু বন উজাড়, প্রজননস্থল নষ্ট হওয়া এবং কিছু অঞ্চলে নির্বিচারে শিকার- এসব কারণে তাদের সংখ্যা অনেক স্থানে কমছে। তাই স্থানীয় বনাঞ্চল সুরক্ষা ও নির্বিচার শিকার রোধের মাধ্যমে এ পাখির প্রাকৃতিক জীবনচক্র রক্ষা করা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় সবুজ ঘুঘুর সংরক্ষণ কার্যক্রম

বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় সবুজ ঘুঘুর নিয়মিত প্রজনন হচ্ছে, যা এই প্রজাতি সংরক্ষণে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় সবুজ ঘুঘুর এনক্লোজারে গাছ রোপণের মাধ্যমে ছায়া-সুনিবিড় এবং প্রকৃতির কাছাকাছি একটি পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, যা পাখিটির প্রজননের জন্য উপযুক্ত। আশা করা যায়, ক্যাপটিভ অবস্থায় বা আবদ্ধ পরিবেশে প্রজননের মাধ্যমে পাখিটির সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। সেই সংখ্যা পর্যাপ্ত হলে সরকারের যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে বনাঞ্চলে এই পাখি অবমুক্ত করা সম্ভব, যা পাখিটির প্রজাতি সংরক্ষণে সহায়ক হবে।

শেষকথা

সবুজ ঘুঘু কেবল একটি পাখির নাম নয়; এটি প্রকৃতির শান্ত সুর, নীরব বনের শ্বাস-প্রশ্বাস। আমরা যদি আমাদের বন আর প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তাহলে সবুজ ঘুঘুরা তাদের পান্না রঙা সৌন্দর্য নিয়ে আরও বহু বছর বাংলার আকাশে উড়ে বেড়াবে-পাতার আড়ালে লুকিয়ে থেকে আমাদের প্রকৃতিপ্রেমের গল্প বলে যাবে।

লেখক: জ্যু অফিসার, বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা, মিরপুর