Sunday 23 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বেস আইসোলেশন: ভূমিকম্পের মাঝেও স্থির থাকা প্রযুক্তি

ফারহানা নীলা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৩ নভেম্বর ২০২৫ ১৭:৩৪

ভূমিকম্প শব্দটি শুনলেই মনে পড়ে কাঁপুনি, আতঙ্ক আর ধ্বংসের ছবি। কিন্তু আধুনিক প্রকৌশল আজ এমন এক প্রযুক্তি তৈরি করেছে, যা ভবনকে ভূমিকম্পের ধাক্কা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে— এই প্রযুক্তির নাম বেস আইসোলেশন। ২০১১ সালের জাপানের ৯.১ মাত্রার ভয়ংকর ভূমিকম্পেও যেসব ভবনে এটি ছিল, সেগুলোর ভেতর যেন অন্য এক নিরাপদ জগত— কাঁচ অটুট, লাইট নিভেনি, যন্ত্রপাতি নড়েনি। কীভাবে সম্ভব হলো এমন বিস্ময়?

মাটির ধাক্কাকে নরম করার জাদু

আমরা সাধারণত ভাবি, ভবন যত শক্ত, ধাক্কা তত সহ্য করবে। কিন্তু প্রকৌশল বলছে উল্টোটা। যখন একটি ভবন মাটির সাথে লোহার রড ও কংক্রিট দিয়ে শক্তভাবে বেঁধে রাখা হয়, ভূমিকম্পের প্রতিটি ঝাঁকুনি সরাসরি ভবনটিকে আঘাত করে। কাঁচ ফেটে যায়, দেয়ালে চেরা ধরে, আর ভেতরের মানুষ আতঙ্কে দৌড়াতে থাকে।

বিজ্ঞাপন

বেস আইসোলেশন ঠিক এই জায়গাতেই বদলে দেয় খেলার নিয়ম। ভবনের নিচে রাবার, স্টিল ও লিড দিয়ে তৈরি বিশেষ বেয়ারিং বা ‘আইসোলেটর’ বসানো হয়। এগুলো ভবনের জন্য নরম বাফারের মতো কাজ করে— মাটি যতই কাঁপুক, ভবন তার মাত্র ২০— ৩০% ধাক্কা অনুভব করে।

স্কেটের মতো স্মার্ট মেকানিজম

ভাবুন, আপনি দাড়িয়ে আছেন একটি বাসে। হঠাৎ ব্রেক করলে আপনি ছিটকে যাবেন। কিন্তু যদি পায়ে স্কেট থাকে? তখন আপনার শরীর ধীরে সামনে গড়িয়ে যাবে— ধাক্কা কম লাগবে। বেস আইসোলেশনও ঠিক এমন।

মাটি দ্রুত কাঁপে, কিন্তু ভবনটি ধীরে দুলে শক্তি শুষে নেয়। ফলে চেরা, ফাটল, ভাঙন— সবই উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

মানুষ ও প্রযুক্তি— দুটোই থাকে নিরাপদ

বেস আইসোলেশনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ইনডোর বা ভবনের ভেতরের নিরাপত্তা। ভূমিকম্পের সময় অপারেশন থিয়েটারের সার্জারি চলছে, সার্ভার রুমের ডেটা সুরক্ষিত, ল্যাবরেটরির শেলফে কোনো যন্ত্র পড়ে ভাঙল না— এমন দৃশ্য জাপান বহুবার দেখেছে। ২০১১ সালের ভয়াবহ সুনামি— ভূমিকম্পেও প্রযুক্তিটি থাকা ভবনগুলো ছিল আশ্চর্যজনকভাবে স্থিতিশীল।

পুরোনো ভবনেও বসানো যায়

সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো— পুরোনো ভবনকেও এই প্রযুক্তি দিয়ে নতুন জীবন দেওয়া যায়। জাপানে বহু পুরোনো ভবন “কেটে— তুলে— ফুটো করে” নিচে বেস আইসোলেটর ঢুকিয়ে আবার বসানো হয়। ব্যয়বহুল হলেও মানুষের জীবন বাঁচানোর দামে এই খরচ সামান্য।

বাংলাদেশেও শুরু হয়ে গেছে ভবিষ্যতের যাত্রা

BNBC— 2020 (বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) ইতোমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বেস আইসোলেশন ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছে। দেশের কিছু অতি— গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে প্রযুক্তিটি ব্যবহারও শুরু হয়েছে। যেমন—
রূপপুর নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট,
মেট্রোরেলের কিছু স্টেশন,
নতুন সরকারি ও বিশেষায়িত ভবন,
এই প্রযুক্তি ঠিক সিটবেল্ট বা এয়ারব্যাগের মতো— প্রতিদিন কাজে লাগে না, কিন্তু একদিন জীবন বাঁচানোর জন্যই এর অস্তিত্ব।

ভূমিকম্পকে থামানো সম্ভব নয়, কিন্তু ধ্বংসকে থামানো সম্ভব। আর সেই লড়াইয়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অস্ত্র এখন বেস আইসোলেশন— পরীক্ষিত, প্রমাণিত, মানুষের জীবন রক্ষায় ভবিষ্যতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন। বাংলাদেশও ধীরে ধীরে সেই ভবিষ্যতের পথে হাঁটছে। একদিন হয়তো আমাদের শহরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ভবনই ভূমিকম্পের মাঝেও থাকবে নিশ্চিন্ত, নিরাপদ— একটি টেকসই ও স্মার্ট যুগের সাক্ষী হিসাবে।

বিজ্ঞাপন

আরো

ফারহানা নীলা - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর