২৪ নভেম্বর। সাদামাটা ক্যালেন্ডারের একটি সাধারণ তারিখ— কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাসে অসাধারণ। এই দিনে, ১৮৫৯ সালে, প্রকাশিত হয়েছিল সেই বই যা মানুষের পৃথিবী দেখার দৃষ্টিভঙ্গিকে আমূল বদলে দিয়েছিল। বইটির নাম ‘On the Origin of Species’। আর সেই বইয়ের লেখক চার্লস ডারউইনের জন্মই বিশ্বের বহু দেশে ২৪ নভেম্বরকে পরিচিত করেছে ‘এভোলিউশন ডে’ হিসেবে।
বিজ্ঞানের ভাষায় দিনটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মজাও কম নয়। কারণ এটি শুধু একটি বইয়ের প্রকাশ–বার্ষিকী নয়; বরং পৃথিবী কীভাবে নিজস্ব সময়রেখায় কোটি কোটি বছরের গল্প লিখে এসেছে— তার উদযাপন।
বিবর্তন— জীবনের সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার
ডারউইনের সময়ে প্রচলিত ধারণা ছিল— সব প্রাণী যেমন আছে, তেমনভাবেই প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ডারউইন বললেন, জীবন স্থির নয়; এটি ক্রমাগত বদলায়, অভিযোজিত হয়, আবার নতুনের জন্ম দেয়।
তার তত্ত্বের দুটি বড় ভিত্তি— Variation (ভিন্নতা) – জীবজগত কখনো পুরোপুরি একই নয়।
Natural Selection (স্বাভাবিক নির্বাচন) – যে বৈশিষ্ট্য টিকে থাকতে সাহায্য করে, সেটিই পরবর্তী প্রজন্মে টিকে থাকে। এই তত্ত্ব আজ আধুনিক জীববিজ্ঞানের মূলভিত্তি। ডিএনএ, জেনেটিক্স, ফসিল— সবই পরে এসে ডারউইনের ভাবনাকে আরও দৃঢ় করেছে।
এভোলিউশন ডে’র মজার দিকগুলো
এ দিনটিকে বিশ্বজুড়ে অনেকেই উদযাপন করেন বেশ হাস্যরসের সঙ্গে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞান সংগঠন, জনপ্রিয় বিজ্ঞান ব্লগ— সবখানে থাকে কুইজ, কার্টুন, আলোচনাসভা আর ‘মজার বিবর্তন তথ্য’।
একটি জনপ্রিয় রসিকতা হলো— ‘আপনি যখন আয়নায় তাকান, তখন সেখানে কোটি বছরের বিবর্তনের ফল দাঁড়িয়ে থাকে।’
এই দিন মানুষ কিছু সহজ পর্যবেক্ষণ করতে উৎসাহিত হয়—
বিড়াল কীভাবে অন্ধকারে পথ খুঁজে পায়?
পাখি কেন ডানার আকার বদলায়?
মানুষের দাঁতের বুদ্ধির দাঁত (wisdom tooth) কেন আসলে এক বিবর্তনগত ‘ভুলে যাওয়া স্মৃতি’?
কোন প্রাণী কীভাবে পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে?
এভোলিউশন ডের আসল মজাই হলো— দৈনন্দিন জীবনের খুব ছোট ছোট ব্যাপারও যে বিবর্তনের ছাপ বহন করে, তা নতুন চোখে আবিষ্কার করা।
ডারউইনের সাহসী সিদ্ধান্ত
ডারউইন তার বই প্রকাশের আগে প্রায় ২০ বছর দ্বিধায় ছিলেন। কারণ তিনি জানতেন— তার তত্ত্ব প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাসকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে। তবু তিনি সত্যের পক্ষে দাঁড়ালেন।
বই প্রকাশের পর শুরু হলো জোরালো বিতর্ক। কেউ বিরোধিতা করল, কেউ সমর্থন দিল। কিন্তু সময়ের সাথে বইটি হয়ে উঠল বিজ্ঞান–ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী গ্রন্থ।
আজ বলা হয়— ‘যে দিন মানবসভ্যতা বৃহত্তর দৃষ্টিতে নিজেকে প্রথম দেখেছিল, সেটি ২৪ নভেম্বর।’
এখনও বিবর্তন ঘটছে— যদিও আমরা তা টের পাই না
অনেকে মনে করেন বিবর্তন অতীতের ঘটনা। কিন্তু বিজ্ঞানের মতে, বিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া …
অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে জীবাণুর প্রতিরোধ (AMR),
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কিছু প্রজাতির নতুন অভিযোজন,
মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনে জিনের পরিবর্তন,
মশার বিষাক্ত প্রতিরোধ ক্ষমতার বিবর্তন,
এসবই বলে— বিবর্তন ঠিক এই মুহূর্তেও ঘটছে।
২৪ নভেম্বর আসলে কী মনে করায়?
এ দিন আমাদের কয়েকটি গভীর সত্যের সামনে দাঁড় করায়— আমরা কোনো ‘হঠাৎ সৃষ্টি’ নই; বরং অসংখ্য পরিবর্তনের দীর্ঘ ইতিহাস। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী— পাখি, গাছ, ব্যাঙ, হাতি— সবাই একই বৃহৎ পরিবারের অংশ।
পরিবর্তনের ক্ষমতাই জীবনের আসল শক্তি। আর আমরা প্রত্যেকেই পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ উপন্যাস— ‘বিবর্তনের গল্প’-এর একটি চলমান অধ্যায়।
শেষ কথা
এভোলিউশন ডে শুধু বিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্য নয়। এটি এমন একটি স্মরণ–দিন, যা আমাদের পরিচয়কে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়।
একদিনের জন্য হলেও পৃথিবীর দিকে ‘ডারউইনের চশমা’ পরে তাকালে বোঝা যায়—
জীবন আসলে কী ভীষণ বিস্ময়কর, বৈচিত্র্যময় এবং সৃষ্টিশীল!