Monday 24 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডি বি কুপার: আকাশে মিলিয়ে যাওয়া এক ছায়ামানবের রহস্য

ফারহানা নীলা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৪ নভেম্বর ২০২৫ ২০:৪১

১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর— বিশ্বের আকাশপথের ইতিহাসে সেই দিনটি চিরকালের জন্য রহস্যে মোড়া। এক ব্যক্তির অস্তিত্ব আজও জানা যায়নি, পাওয়া যায়নি তার দেহ, খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনো নিশ্চিত ক্লু— তবু তার নাম কিংবদন্তি হয়ে গেছে। তিনি D.B. Cooper, আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যজনক উড়োজাহাজ ছিনতাইকারী, যিনি ১০ হাজার ফুট ওপরে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে প্যারাসুট বেঁধে অদৃশ্য হয়ে যান— চিরতরে।

এক সাধারণ যাত্রীর মতো শুরু

১৯৭১ সালের থ্যাঙ্কসগিভিং-এর আগের দিন। পোর্টল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটা বোয়িং ৭২৭-এ উঠে বসেন এক ভদ্রলোক। টিকেটে নাম লেখা— ড্যান কুপার। পরে সংবাদমাধ্যমের ভুল প্রতিবেদনের কারণে তিনি পরিচিত হন ডি বি কুপার (D.B. Cooper) নামে।

বিজ্ঞাপন

পরনে গাঢ় স্যুট, কালো টাই, পরিপাটি পোশাক। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। কাউকে সন্দেহ জাগানোর মতো কিছুই নেই। বিমানে উঠে সিটে বসেই তিনি সিগারেট ধরালেন— সেই সময় এটা নিষিদ্ধ ছিল না। যেন অফিসফেরত কোনো ক্লান্ত মানুষ।

বোমার হুমকি— কিন্তু অদ্ভুতভাবে শান্ত

ফ্লাইট টেক-অফ করার কিছুক্ষণ পরই কুপার কেবিন অ্যাটেনডেন্ট ফ্লোরেন্স শ্যাফনারের হাতে একটি নোট ধরিয়ে দেন। নোটটি তিনি প্রথমে পড়েননি— ভেবেছিলেন ফোন নাম্বার বা অন্য কিছু। কুপার শান্তভাবে বলেন, ‘Madam, you better read that. I have a bomb.’

ফ্লোরেন্স যখন ফিরে তাকান, দেখেন কুপার ব্রিফকেস খুলে ভিতরে লাল তার, ব্যাটারি, সিলিন্ডার— দেখতে যেন সত্যিই বোমা। এরপর তিনি দাবি করেন— ২০০,০০০ ডলার নগদ, চারটি প্যারাসুট, সিয়াটলে জ্বালানি ভরার সুযোগ।

একজন হাইজ্যাকারকে যেমন অস্থির, আগ্রাসী ভাবা যায়— কুপার তেমন ছিলেন না। তিনি অত্যন্ত ভদ্র, শান্ত এবং হিসেবী ছিলেন। যাত্রীদের কেউই জানলেন না, তাদের মাথার উপর তখন এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি ঝুলছে।

সিনেমার দৃশ্যের মতো সিয়াটলে নামা

এফবিআই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। সিয়াটল-টাকোমা এয়ারপোর্টে টাকা ও প্যারাসুট পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কুপারের নির্দেশে বিমানের যাত্রীদের কিছুই না বুঝিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়। একজন যাত্রী পরে বলেন, ‘আমরা ভাবতেই পারিনি কিছু অস্বাভাবিক ঘটছে!’

বিমানের ভেতরে তখন শুধু ক্রু, দুই পাইলট এবং কুপার। টাকা ও প্যারাসুট হস্তান্তরের পর শুরু হয় রহস্যের দ্বিতীয় অধ্যায়।

দ্বিতীয়বার উড্ডয়ন— অজানা গন্তব্যে

কুপারের নির্দেশ ছিল—
বিমান ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় উড়বে,
গতি কম রাখতে হবে,
পেছনের দরজা (air-stairs) খোলা থাকবে,
দক্ষিণ দিকে, মেক্সিকোর দিকে এগোবে,
পাইলটদের ভাষায় এই শর্তগুলো অদ্ভুত এবং ঝুঁকিপূর্ণ। তবু তারা মানতে বাধ্য।

বিমানের ভেতর থেকে কুপার একটি বোরবন পান করেন, সিগারেট খান— এমন আচরণ যেন তিনি ছিনতাই নয়, বরং কোনো প্রস্তুতি নিচ্ছেন এক মহা অভিযানের।

ঝড়ের রাতে ১০ হাজার ফুট থেকে লাফ

রাত প্রায় ৮টার কাছাকাছি সময়। বাইরে কালো অন্ধকার, বৃষ্টি, ঠান্ডা বাতাস— অভিজ্ঞ স্কাইডাইভারকেও পিছিয়ে দেবে এমন আবহাওয়া।

হঠাৎ পাইলটরা অনুভব করেন পেছনের দরজা খোলা। কুপার প্যারাসুট বেঁধে প্রস্তুত। এরপর পিছন দিক থেকে জোরালো বাতাস ঢোকার শব্দ— এবং সেই মুহূর্তে তিনি লাফ দেন।

সেই লাফের পর থেকে তিনি— অদৃশ্য। চিরতরে।

আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অনুসন্ধান

কুপারের লাফ দেওয়ার পর শুরু হয় এক বিশাল অনুসন্ধান অভিযান—
হাজার হাজার পুলিশ ও সেনা, পাহাড়ি ও বনাঞ্চলে খোঁজ, নদী, উপত্যকা, খাড়া পাহাড়
হেলিকপ্টার, ড্রোন, ট্র্যাকিং ডগ, কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে— একটাও নিশ্চিত প্রমাণ মিলল না।

লাফ দেওয়ার পর কুপার মারা গেছেন— এমন দাবি অনেকের। কারণ—
তিনি যে জায়গায় লাফ দিয়েছেন সেখানে ঘন বন, প্রচণ্ড ঠান্ডা, সঠিক ল্যান্ডিং অসম্ভব প্রায়, তিনি স্যুট-জুতা পরে ছিলেন, স্কাইডাইভিং গিয়ার নয়, তবুও প্রশ্ন থাকে— মৃত হলে দেহ পাওয়া গেল না কেন?

১৯৮০ সালে শিশু হাতে উঠে আসে রহস্যের টুকরো

ঘটনার নয় বছর পর— ১৯৮০ সালে— কলম্বিয়া নদীর পাশে এক শিশু বালুর নিচে খুঁজে পায় ৫,৮০০ ডলার। সিরিয়াল নম্বর পরীক্ষা করে দেখা যায়— এগুলো কুপারকে দেওয়া টাকারই অংশ।

এটা প্রশ্ন আরও বাড়ায়— তিনি কি নদীতে পড়ে গিয়েছিলেন?
না কি বেঁচে গিয়ে কোনোভাবে এই টাকাগুলো এখানে এসে পড়েছিল?
ডি বি কুপার- অপরাধী না কিংবদন্তি?
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে কুপার আজ এক অ্যান্টি-হিরো। কারণ—
তিনি কাউকে আঘাত করেননি, যাত্রীদের ক্ষতি করেননি, শান্ত, ভদ্র, বিনয়ী আচরণ, নিখুঁত পরিকল্পনা এবং নিখুঁতভাবে পালিয়ে যাওয়া, সময়ের সঙ্গে তিনি হয়ে ওঠেন এক প্রতীকি চরিত্র— স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, রোমাঞ্চের নেশা, ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী রহস্যমানব। গান, সিনেমা, ডকুমেন্টারি, উপন্যাস, এমনকি টিভি সিরিজেও তার চরিত্র অনুপ্রেরণা হয়ে আছে।

তিনি আসলে কে ছিলেন?

এফবিআই বছরের পর বছর ধরে ডজন ডজন সন্দেহভাজনকে খতিয়ে দেখেছে—
সামরিক স্কাইডাইভার, পাইলট, অপরাধী, সাবেক প্যারাট্রুপার, সাধারণ কর্মচারী সবাইকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারো সঙ্গেই পুরোপুরি মিল পাওয়া যায়নি। এমনকি আধুনিক ফরেনসিকেও কোনও নিশ্চিত উপসংহার নেই।

সবচেয়ে আলোচিত তত্ত্বগুলো—

তিনি পেশাদার স্কাইডাইভার ছিলেন। কারণ—
বোয়িং ৭২৭-এর পেছনের দরজা কীভাবে খোলা যায় জানতেন, সঠিক ধরনের প্যারাসুট বেছে নিয়েছিলেন, ১০,০০০ ফুট থেকে লাফের ভয় পাননি, তিনি সাধারণ মানুষ, কিন্তু রোমাঞ্চপ্রেমী।

অনেকে মনে করেন, কুপার হয়তো বড় কোনো অপরাধী ছিলেন না। বরং জীবনে বড় কোনো অ্যাডভেঞ্চার করতে চেয়েছিলেন।

তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন

কেউ বলেন—
তিনি হয়তো আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন, নিরাপদ স্থানে অবতরণ করেন, নতুন পরিচয়ে নতুন জীবন শুরু করেন, হয়তো আজও কোথাও বেঁচে আছেন, যদিও এর কোনো প্রমাণ নেই।

২০১৬ সালে তদন্ত বন্ধ— কিন্তু রহস্য নয়

৪৫ বছর তদন্তের পর ২০১৬ সালে এফবিআই ঘোষণা দেয়— তদন্ত বন্ধ। কারণ—
নতুন কোনো ক্লু নেই, কোনো সম্ভাবনা নেই, কোনো আধুনিক প্রযুক্তিও আর সাহায্য করছে না।

কিন্তু বন্ধ হয়নি মানুষের কৌতূহল। প্রতি বছর নভেম্বর এলেই সংবাদমাধ্যম, ব্লগ, ফোরাম, ডকুমেন্টারি— সব জায়গায় আবার জেগে ওঠে প্রশ্ন—
D.B. Cooper কোথায় গেলেন? তিনি কি বেঁচে ফিরেছিলেন?

শেষ কথা: রহস্যই তার পরিচয়

D.B. Cooper শুধু একজন উড়োজাহাজ ছিনতাইকারী নন। তিনি এক সাংস্কৃতিক প্রতীক— এক রহস্য, যে রহস্য মানব কৌতূহলকে চিরকাল নাড়িয়ে দেবে।

তার গল্পে আছে— পরিকল্পনার নিখুঁততা, পালানোর কৌশল, মানব সাহসের সীমা, আর অজানার প্রতি আকর্ষণ। ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু Cooper আজও বেঁচে আছেন মানুষের গল্পে— হয়তো সেই রাতের লাফের মতোই, অন্ধকারে, কিন্তু আলো ছড়ানো এক কিংবদন্তি হয়ে।

সারাবাংলা/এফএন/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আরো

ফারহানা নীলা - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর