Wednesday 26 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আহসান মঞ্জিল: ঢাকার নীরব সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন

সানজিদা যুথী সিনিয়র নিউজরুম এডিটর
২৬ নভেম্বর ২০২৫ ১২:২৪

ঝলমলে গোলাপি প্রাসাদ… বুড়িগঙ্গার ঢেউয়ে ভেসে আসে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের নিঃশ্বাস। রাতের অন্ধকারে আহসান মঞ্জিল দাঁড়িয়ে থাকে এক নীরব প্রহরীর মতো— সব দেখেছে, কিছুই বলছে না। কখনো এখানে বাজতো রাজনীতির সুর, কখনো চলত ক্ষমতার খেলা… আর আজ— শুধু পর্যটকের ক্যামেরার ক্লিক!

এই প্রাসাদটি পুরান ঢাকার ইসলামপুরের কুমারটুলীতে, নদীর ধারে অবস্থিত। ১৮৫৯ সালে নওয়াব আবদুল গনি নির্মাণ শুরু করেন এবং ১৮৭২ সালে শেষ করেন, নিজের প্রিয় পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামে নামকরণ করে— ‘আহসান মঞ্জিল’।

কিন্তু এই প্রাসাদের গল্প শুধু রাজকীয় সৌন্দর্য নয়। ১৮৮৮ সালের ভূমিকম্প এবং ১৮৯৭ সালের আরেক আঘাত প্রাসাদকে ভেঙে ফেললেও নবাবেরা তা পুনঃনির্মাণ করেন। সময়ের সঙ্গে অর্থাভাব, জমিদারি সংকোচন, অতি বিলাসিতা— সব মিলিয়ে নবাবদের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে।

বিজ্ঞাপন

প্রাসাদের স্থাপত্যও অদ্বিতীয়

এক মিটার উঁচু বেদির ওপর নির্মিত দুই তলা, সুন্দর গম্বুজ, ত্রি-তোরণবিশিষ্ট প্রবেশদ্বার, ভুতুড়ে নকশার বারান্দা। ভেতরে আছে বৈঠকখানা, পাঠাগার, নাচঘর, হামামখানা— ইউরোপীয় ধাঁচের বাষ্পঘর, মার্বেল মেঝে এবং উঁচু ছাদের বলরুম। সবকিছু যেন এক সময়ের রাজকীয় জীবনকাহিনীই বলে যাচ্ছে।

১৮০০–১৯০০ সালের ঢাকার রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি সবই এই প্রাসাদের ভেতরে নির্ধারিত হতো। এখানেই মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। ইংরেজ গভর্নর, বিদেশি বণিক, জমিদারি আইন— সব আলোচনার কেন্দ্র এই গোলাপি দেয়াল।

জৌলুস স্থায়ী হয়নি

১৯০৫ সালের ভয়াবহ টর্নেডো, রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক সংকট— সব মিলিয়ে নবাব পরিবারের ক্ষমতা ক্ষয় পায়। ১৯৫২ সালে জমিদারী উচ্ছেদের পর আহসান মঞ্জিল প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্তির পথে চলে।

ইতিহাস কখনো সম্পূর্ণ মরে না

১৯৮৫ সালে সরকারের উদ্যোগে প্রাসাদটি পুনর্গঠিত হয়, ধ্বংসস্তূপ সরানো হয়, সংগ্রহ করা হয় স্মৃতিসংবলিত আসবাবপত্র, ঘড়ি, চিঠি, পোশাক। ১৯৯২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় জাদুঘর হিসেবে।

এখন আহসান মঞ্জিল শুধু একটি প্রাসাদ নয়— এটি স্মরণ করিয়ে দেয় ক্ষমতার অস্থায়িত্ব, সময়ের অদম্য সত্য। এই মনজিল শুধু স্থাপনা নয়—এটি স্মরণ করিয়ে দেয় অতীতের গৌরব, হারানো গল্প, আবেগ আর মানব জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব। যে পরিবার এক সময় ঢাকার ভাগ্য লিখত, তাদের গল্প আজ কাঁচের প্রদর্শনীতে ফিসফিস করছে— “উত্থান যেমন নিশ্চিত, পতনও অনিবার্য।”

দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা নীরব প্রহরীর মতো, আহসান মঞ্জিল এখনও আমাদের অপেক্ষা করছে, অতীতের গৌরবকে চোখে তুলে ধরে। যখন নদীর হাওয়া ছুঁয়েছে বারান্দা— মনে হয় যেন দেয়ালগুলো এখনও ফিসফিস করে বলছে, “আমাদের গল্প শুনতে কি তুমি প্রস্তুত?”

ঢাকার হৃদয়ে, বুড়িগঙ্গার তীরে— এটাই আহসান মঞ্জিল। এটি শুধু ইতিহাস নয়, এটি অনুভূতি, এটি আবেগ, এটি আমাদের নীরব শিক্ষক।

বিজ্ঞাপন

আরো

সানজিদা যুথী - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর