ভাবুন তো— ঘুম থেকে উঠে দেখলেন আপনার মোবাইলের ক্যালেন্ডারে সাল চলছে ২০১৮। প্রথমে নিশ্চয়ই মনে হবে ফোনে সমস্যা হয়েছে। কিন্তু যদি বলি, ইথিওপিয়ায় এটিই স্বাভাবিক ঘটনা? সেখানে সত্যিই এখন ২০১৮ সাল চলমান— আর তারা এতে মোটেও অবাক নয়! অদ্ভুত শোনালেও, ইথিওপিয়া যেন সময়ের এক অন্য রাজ্য, যেখানে ক্যালেন্ডার, ঘড়ি, এমনকি নতুন শতাব্দীর তারিখ— সবই দুনিয়ার থেকে আলাদা।
রহস্য: কেন তারা বিশ্বের থেকে সাড়ে সাত বছর পিছিয়ে?
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে। কিন্তু ইথিওপিয়া এখনও ধরে রেখেছে তাদের প্রাচীন ইথিওপিয়ান ক্যালেন্ডার— যা তৈরি হয়েছিল প্রাচীন খ্রিস্টীয় সময় গণনার ওপর ভিত্তি করে।
একটি ঐতিহাসিক তথ্য বলছে— ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান চার্চ গ্রেগরিয়ান পদ্ধতিতে গণনা সংশোধন করলেও ইথিওপিয়া সে পথে হাঁটেনি। ফলে দুই হিসাবের মাঝে তৈরি হয় ৭–৮ বছরের পার্থক্য। এই কারণেই বিশ্ব যখন নতুন সহস্রাব্দ উদযাপন করেছে ২০০০ সালে, ইথিওপিয়া তখন তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০০৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উদযাপন করেছে তাদের নতুন শতাব্দী!
১৩ মাসের দেশ: ক্যালেন্ডারের গড়মিল নাকি সাংস্কৃতিক বিস্ময়?
ইথিওপিয়ায় বছর গণনা হয় এভাবে—
১৩টি মাস,
১২ মাসে ৩০ দিন করে,
আর “পাগুমে” নামের বিশেষ মাসে ৫ বা ৬ দিন,
এজন্য তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিন, উৎসব ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান—বিশ্বের বাকি অংশের তারিখ থেকে আলাদা দিনে পড়ে।
ঘড়িও চলে ভিন্ন নিয়মে
ইথিওপিয়ায় সময় গণনা শুরু হয় সূর্য ওঠার মুহূর্ত থেকে। অর্থাৎ— সূর্যোদয় = ০ ঘণ্টা, আমাদের সকাল ৭টা = তাদের ১ ঘণ্টা, মনে হয় যেন পুরো দেশটাই সময়ের সঙ্গে নিজের আলাদা একটা বোঝাপড়া করে নিয়েছে।
পর্যটকদের কোনো ঝামেলা হয় না
এত ভিন্নতার পরও আশ্চর্যজনকভাবে বিদেশি পর্যটকদের কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। হোটেল, এয়ারলাইন, ট্যুর কোম্পানি— সবাই আন্তর্জাতিক সময় অনুযায়ী চলেই। তাই ইথিওপিয়ার ভিন্ন ক্যালেন্ডার পর্যটকদের জন্য বাড়তি এক রোমাঞ্চ ছাড়া আর কিছুই নয়।
মানুষের সবচেয়ে পুরোনো পদচিহ্ন
ক্যালেন্ডারের মতোই ইথিওপিয়ার ভূমিও বহন করে এক বিশাল ইতিহাস। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে দেখা যায়— দেশটির আফার অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মানব বসতির একটি।
এখানে খননকালে পাওয়া গিয়েছিল— ৩.২ মিলিয়ন বছরের পুরোনো হোমিনিড কঙ্কাল, বিশ্বখ্যাত লুসি। যে আবিষ্কার প্রমাণ করে— মানব বিবর্তনের প্রাচীন অধ্যায়গুলোর জন্ম এই আফ্রিকান ভূমিতেই। এই কারণে ইথিওপিয়াকে প্রায়ই বলা হয়— “হিউম্যানিটির ক্রেডল” বা মানবজাতির জন্মভূমি।
এক অন্য সময়ের দেশে পা রাখার অনুভূতি
ইথিওপিয়া এমন এক দেশ—যেখানে সময়কে নিজের মতো করে সাজানো হয়েছে। তারা ইতিহাস বদলাতে চায় না, বরং সেই ইতিহাসকেই জীবন্ত রেখে এগিয়ে চলে।
বিশ্ব যখন ভবিষ্যতের দিকে ছুটছে, ইথিওপিয়া যেন বলে— “সময়কে নিজের মতো করে বাঁচানোই আসল আনন্দ।”
তাই সেখানে গেলে বুঝবেন— সময় শুধু ঘড়ির কাঁটায় মাপা যায় না, একটি জাতির স্মৃতি আর সংস্কৃতিতেও সময়ের গল্প লুকিয়ে থাকে।