মানবসভ্যতার ইতিহাসে ‘কাগজ’ শব্দটি প্রথম যে রূপে দেখা দেয়, তা হলো প্যাপিরাস। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ১৫০০ সাল থেকে মিসরীয়রা নীল নদের তীরে জন্মানো প্যাপিরাস উদ্ভিদের ভেতরের সাদা নরম অংশ থেকে এই পাতলা, মসৃণ শিট তৈরি করত। তখন চামড়া, পাথর বা মাটির ফলকের ওপর লেখা চললেও প্যাপিরাসের সহজ বহনযোগ্যতা ও টেকসই বৈশিষ্ট্য যোগাযোগব্যবস্থাকে বদলে দেয়।
কীভাবে তৈরি হতো প্যাপিরাসের কাগজ
উদ্ভিদের সাদা অংশ লম্বালম্বিভাবে কাটার পর অনুভূমিক ও উল্লম্ব স্তরে সাজিয়ে চেপে ধরা হতো। শুকিয়ে গেলে তৈরি হতো হালকা, নমনীয় একটি পাত—যা দেখতে আজকের কাগজের আদিম সংস্করণ। এই প্রযুক্তির সরলতা এবং কার্যকারিতা মিসরীয়দের জ্ঞান-সংরক্ষণে এক নতুন যুগের সূচনা করে।
নবরাজ্যে প্যাপিরাসের জৌলুস
মিসরীয় সভ্যতার তিন যুগের মধ্যে নবরাজ্যের সময় প্যাপিরাসের ব্যবহার সর্বাধিক বাড়ে। এ সময়কার মানুষ মৃত্যুর পরের জীবনকে কেন্দ্র করে অসংখ্য ধর্মীয় আচার, মন্ত্রপাঠ, নৈতিকতা ও নিয়মাবলি প্যাপিরাসে লিখে রাখত। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘দ্য বুক অব ডেথ’, যা মৃতব্যক্তির পরকালযাত্রার জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বইটির একটি কপি আজও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত।
শুধু ধর্ম নয়— জীবনের প্রতিটি দিকের দলিল
প্যাপিরাস ছিল শুধু ধর্মীয় লিপির বাহন নয়; ছিল চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, কর-হিসাব, ব্যবসায়িক চুক্তি, এমনকি প্রেমপত্র লেখার মাধ্যমও। রাজা-ফারাওয়ের আদেশ থেকে কৃষকের নিত্যদিনের নোট—সবই লেখা হতো প্যাপিরাসে। শিল্পীরাও এটি ব্যবহার করতেন চিত্রাঙ্কনের ক্যানভাস হিসেবে। ফলে প্যাপিরাস হয়ে ওঠে মিসরীয় জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নথিপত্র।
হোমার এবং ভূমধ্যসাগরীয় জগতে প্যাপিরাস
মিসরের সীমা ছাড়িয়ে প্যাপিরাস পৌঁছে যায় গ্রিস ও রোমে। ধারণা করা হয়, গ্রিসের মহাকবি হোমারের ইলিয়াড লেখা হয়েছিল প্যাপিরাসের ২৪টি রোলে। ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের মাধ্যমে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে এই কাগজ বড় ভূমিকা রাখে। ভাষাতাত্ত্বিকভাবে আজকের ইংরেজি শব্দ ‘paper’–এর মূলও লুকিয়ে রয়েছে ‘papyrus’–এ।
আদিম কাগজের আধুনিক উত্তরসূরি
পরে যদিও কাগজ তৈরির উন্নত প্রযুক্তি চীন, আরব ও ইউরোপে ছড়িয়ে যায় এবং আধুনিক সেলুলোজ-ভিত্তিক কাগজ প্যাপিরাসের জায়গা নেয়, তবুও প্যাপিরাসের গুরুত্ব অটুট। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, লিখিত জ্ঞান সংরক্ষণ, আইন প্রণয়ন, শিল্পের বিস্তার এবং বৈজ্ঞানিক চর্চার যে ধারাবাহিকতা আজ বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত—তার ভিত্তি এই জলজ উদ্ভিদ থেকেই শুরু।
প্যাপিরাস: সভ্যতার প্রথম লাইব্রেরি
অতএব প্যাপিরাস শুধু কাগজ ছিল না—এ ছিল সভ্যতার প্রথম লাইব্রেরি, প্রথম নোটবুক, প্রথম চিত্রপট। এর পাতা ধরেই মানুষ তার স্বপ্ন, ভয়, প্রার্থনা, ধর্ম, বিজ্ঞান ও মহাকাব্যকে ধরে রেখেছে হাজার বছর ধরে। পৃথিবীর কাগজের ইতিহাস শুরু হয়েছিল নীল নদের সেই শান্ত, সবুজ তীরেই—একটি সাধারণ উদ্ভিদের পাতলা সাদা অংশ থেকে।