বুড়িগঙ্গার স্রোত মুছে গেছে বহু বছর… ইতিহাসের ধুলোর নিচে চাপা পড়ে আছে এক নিঃশব্দ শহর— পানাম নগর। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই শহর যেন সময়ের হাতছোঁয়া পাথরের এক মহাভাষ্য… যা বলছে বারো ভূইয়াঁ, মসলিন, নীলচাষ আর ভুলে যাওয়া বেদনার গল্প।
সোনারগাঁর তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিল সবচেয়ে মোহনীয়। বক্ররেখার মতো বাঁকানো পুল পেরিয়ে ঢুকতেই মিলত লম্বা রাস্তা, আর দুই পাশে সারি সারি শতবর্ষী বাড়ি— যেন ইটগুলো নিজেই ইতিহাস লিখছে।
একদিন ঈসা খাঁর পদচারণায় মুখর ছিল এই নগর। মেঘনা আর শীতলক্ষ্যার ঘাটে নোঙর ফেলত পালতোলা নৌকা… বিলেতে যেত বাংলার মসলিন, আর আসত রূপোলি থানকাপড়। ঔপনিবেশিক স্থাপত্য, মোঘল কারুকাজ, গ্রিক শৈলী— সব মিলেমিশে পানামের প্রতিটি বাড়িকে করেছে একেকটি শিল্পকর্ম।
৫২টি স্থাপনা— যেন ৫২টি গল্প। কোথাও খিলান, কোথাও কাস্ট আয়রনের গর্বিত কাজ, কোথাও লাল–সাদা মোজাইকের মেঝেতে ঘুমিয়ে আছে হারানো সময়। প্রতিটি বাড়ির ভেতরেই আছে উঠোন, গোপন পথ, পানির কূপ… আর আছে এমন নাচঘর যেখানে একসময় বাজত মেঘমল্লার, আজ সেখানে ভর করে আছে নীরবতা।
১৬১১ সালে মোগলদের আগমনে শহরের সঙ্গে বেড়ে যায় যোগাযোগ, শহরটি হয়ে ওঠে বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু ইতিহাস শুধু গৌরবই আনে না—আনে পতনের সুরও। ব্রিটিশরা আগমনের পর বদলে যায় পানামের ভাগ্য। বহু মুসলিম ব্যবসায়ী এলাকা ছেড়ে চলে যান, সামন্তশ্রেণির হিন্দু ব্যবসায়ীরা গড়ে তোলেন নতুন বসতি। আর যখন তারাও সময়ের স্রোতে ভেসে যায়— পানাম নগর ধীরে ধীরে পরিণত হয় ভূতুরে নিস্তব্ধতায়।
ভাঙা দেয়াল, শ্যাওলা ধরা ছাদ, কোথাও ভেঙে পড়া সিঁড়ি, কোথাও গাছের শিকড়ে গিলে খাওয়া ঘর… কেউ বলে— এ শহর আর বাঁচবে না। কিন্তু ইতিহাস কখনো হারায় না। বাংলাদেশ সরকার পানাম নগরকে উদ্ধার করতে হাতে নেয় সংরক্ষণ প্রকল্প— প্রাচীন বাড়ি পুনর্নির্মাণ, পুকুরঘাট সংস্কার, সেতু মেরামত…
যদিও বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা রয়ে গেছে— সংস্কারের নামে যেন হারিয়ে না যায় আসল সৌন্দর্য।
পানাম শুধু একটি শহর নয়— এ এক জীবন্ত স্মৃতি, এক হারানো সময়ের দর্পণ, যেখানে প্রতিটি ইট বলছে— “আমাকে ভুলে যেও না।”
পানামের নীরবতা আজও ভেঙে ওঠে গল্পে, সুরে, সিনেমার দৃশ্যে। গেরিলা থেকে সুবর্ণগ্রাম— পানাম নগর রূপসজ্জার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে চিরকালের শিল্পে। হয়তো কোনোদিন ভোরের আলোয় আবারো জেগে উঠবে এই নগর… আবারো নদীর স্রোতে ভেসে আসবে মসলিনের গান… আর পানাম নগর শোনাবে তার হাজার বছরের গল্প।