মগবাজার… আজকের ঢাকা শহরের কেন্দ্রীয় এক ব্যস্ত এলাকা। কিন্তু জানেন কি—এই নামের পেছনে লুকিয়ে আছে চারশ বছরের এক ইতিহাস? যেখানে আছে নদীর গল্প, অরণ্যের গল্প… আর আছে এক রাজবংশের উত্তরসূরিদের সংগ্রাম।
একসময় ঢাকার এই অংশে প্রবাহিত হতো পান্ডু নদী। নদীর দুই তীর জুড়ে ছিল ঘন জঙ্গল, পতিত জমি আর অরক্ষিত বিস্তীর্ণ প্রান্তর। সেই নির্জন ভূমি কেটে, বন সরিয়ে চাষাবাদ শুরু করে এক বিশেষ জনগোষ্ঠী— মগরা। তাদের বসতি গড়ে ওঠার পরই এলাকার নাম হয়— মগবাজার।
কিন্তু মগ কারা?
আরাকান রাজবংশের সঙ্গে সম্পর্কিত এই জাতি সমুদ্রযাত্রায় দক্ষ, পরিশ্রমী আর কৃষিকাজে পটু ছিল। জনশ্রুতি আছে— মগরা নাকি নদীপথে দস্যুগিরি করত… কিন্তু ইতিহাস বলছে আরও বড় কথা। ১৬৩০–৩৫-এর দিকে মগ রাজার ভাতিজা মুকুট রায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলে, তার অনুসারীদের স্থান দেওয়া হয় পান্ডু নদীর ধারেই। সেখানেই গড়ে ওঠে প্রথম মগ বসতি— যেখানে আজ মগবাজার, নয়াটোলা, মধুবাগ, দিলু রোড।
গবেষণা বলছে— এই এলাকায় এখনও রয়েছে বেশ কিছু পরিবার, যারা নিজেদের পরিচয় দেয়— ‘আমরা মগ রাজবংশের উত্তরসূরি।’
মগবাজার মোড়ের সরদার পরিবার, দিলু রোডের শেখ দিলু পরিবার, নয়াটোলার জুম্মন বক্স পরিবার, মধুবাগের আলী বক্স পরিবার— এরা একসময় শত শত বিঘা জমির মালিক ছিলেন। আজ জমি নেই হয়তো, তবে আছে স্মৃতি… আছে ইতিহাসের অক্ষয় চিহ্ন।
মগদের চাষ করা বেগুন আর লাউ একসময় ঢাকার ধনী পরিবারগুলোতে দারুণ জনপ্রিয় ছিল। মুগল আমলে নির্মিত তাদের একগম্বুজ মসজিদ— আজকের রমনা থানা মসজিদ— এখনো দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন দিনের সাক্ষী হয়ে।
ব্রিটিশ আমলে নবাব আব্দুল গনি নিজ হাতে পাগড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন প্রথম সরদার হানিফ বক্সকে। তার পরবর্তী প্রজন্ম— বিশেষ করে ওসমান গনি সরদার— ঢাকার বাইশ পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলেন বহু বছর। এফডিসির সামনে রাস্তার নাম ‘ওসমান গনি সড়ক’— তাদেরই স্মৃতি।
মগবাজারের জীবন ছিল একসময় নদীনির্ভর। রামপুরা খালের পানিতে তখনো নৌকা চলত। বেরাইদ–সাঁতারকুল থেকে কাঠাল, চাল–ডাল, মাটির বাসন আসত নৌকায়। আর বিকেলে মগ পরিবারের লোকজন নৌকা ভ্রমণে যেত দূরের দিকে। মেয়েরা যাতায়াত করত ঘোড়ার গাড়িতে… ঢাকার সেই দৃশ্য এখন শুধু স্মৃতি।
সিদ্ধেশ্বরীর দিকে ছিল তাদের বিশাল বাগানবাড়ি। সেখানকার পুকুরের জায়গাতেই আজ দাঁড়িয়ে আছে সেঞ্চুরি আর্কেড— কিন্তু লোকমুখে জায়গাটির নাম এখনো ‘ইস্পাহানি পুকুর’ হিসেবেই পরিচিত।
মগ রাজবংশের বংশধররা বলেন— ‘আমরা চারশ বছর ধরে এই শহরের অংশ। শহর বদলে গেছে, বাড়িঘর ভেঙে গেছে, নদী শুকিয়ে গেছে… কিন্তু মগবাজার নামের ভেতর এখনো আমাদের ইতিহাস বেঁচে আছে।’
মগবাজার… শুধু একটা এলাকা নয়; এটা ঢাকা শহরের লুকানো এক অধ্যায়— যেখানে অতীত, নদী, রাজবংশ আর মানুষের সংগ্রাম মিশে আছে এক সূক্ষ্ম ইতিহাসে।