Thursday 04 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

১৯৭১: যেখানে নারীরা ছিলেন স্বাধীনতার নীরব গর্জন

সানজিদা যুথী সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:১৯ | আপডেট: ৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:২১

রাত তখন গভীর। গ্রামের মেঠোপথের ওপর কুয়াশা নেমে এসেছে। দূরে কোথাও সামান্য গুলির শব্দ… হঠাৎই একটি কিশোরী মেয়ে, হাতে দেশলাইয়ের আলো, মাটির ঘরের আড়াল থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল— ‘ওরা চলে গেছে… এখনই যেতে হবে মুক্তিবাহিনীর কাছে খবর দিতে!’

এই মেয়েটির নাম কেউ জানত না। কিন্তু তার ছুটে যাওয়া প্রতিটি পদক্ষেপে লুকিয়ে ছিল একদেশের স্বাধীনতার গল্প। এটাই ছিল ১৯৭১— যেখানে বাংলাদেশের নারীরা শুধু মা-বোন হয়ে থাকেনি; তারা হয়ে উঠেছিল যোদ্ধা, গাইড, গুপ্তচর, সেবিকা, আশ্রয়দাতা… আর স্বাধীনতার নেপথ্যের নায়িকা।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১১ হাজারেরও বেশি নারী বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হন— যার মধ্যে কয়েক শত নারী সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন।

বিজ্ঞাপন

ক্যাপ্টেন তসলিমা বেগম (বীর প্রতীক) — যুদ্ধে অংশ নেওয়া কয়েকজন স্বীকৃত নারী যোদ্ধার একজন।

সেতারা বেগম, রুমা, হালিমা খাতুন— সীমান্তে রাইফেল কাঁধে নিয়ে পুরুষ যোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন।

অনেকে ছদ্মবেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের অনুচরদের ভেতর ঢুকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, এমনকি নাশকতাও চালিয়েছেন।

তাদের গল্পের বেশিরভাগই অবলিখিত… কিন্তু স্বাধীনতার প্রতিটি ইঞ্চিতে তাদের পদচিহ্ন আছে।

মুক্তিযোদ্ধারা যখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতেন, তখন সবচেয়ে বড় আশ্রয়দাতা ছিল— বাংলার মা, বোন, গৃহবধূরা।

কেউ রাতভর রুটি বেলেছেন। কেউ মাটির চুলোয় ভোররাতে রান্না করেছেন। আবার কেউ গোপনে ঘরে ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। অনেক মা সন্তানকে বাঁচানোর মতো করে লুকিয়ে রেখেছেন স্বাধীনতাসৈনিকদের। ইউনিফর্ম না থাকলেও, তাদের হাঁড়ি-পাতিলের শব্দই ছিল যুদ্ধে আরেক ধরনের অস্ত্র।

ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ক্যাম্পে শত শত নার্স ও সেবিকা কাজ করেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য—

ডা. জোহরা বেগম কাদের— সিলেট ও সীমান্ত এলাকার ট্রেনিং ক্যাম্পে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছেন। খোলা আকাশের নিচে, অচেনা ঘর-বাড়িতে, কখনো অল্প আলোয়… অপারেশন করেছেন, সেলাই দিয়েছেন, জীবন বাঁচিয়েছেন।

ডা. সেতারা বেগম, ডা. রওশন আরা, নার্স ফিরোজা— তাদের হাতের সেলাই না থাকলে হয়তো অনেক যোদ্ধাই বেঁচে ফিরত না।

সংস্কৃতি জগতের নারীরাও —গান, অভিনয়, কবিতায় যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন, যুদ্ধের সময় যেমন বন্দুক ছিল, তেমনই ছিল সংগীত ও শিল্পের আগুন।

মুক্তিযুদ্ধে নমিতা ঘোষ, আফরোজা মামুন, জোৎস্না রাণী ভৌমিক, মায়া সাহা, শাকিলা চৌধুরী, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, নীলিমা সাহা, রত্না বিশ্বাস এবং শারমিন মুরশিদ-এর মতো নারী শিল্পীরা গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে ও তহবিল সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাদের মধ্যে নমিতা ঘোষ প্রথম নারী শিল্পী হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন এবং আফরোজা মামুন একজন ‘কণ্ঠযোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত।

ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্পে, শরণার্থী শিবিরে, যুদ্ধফ্রন্টে— যেখানে যোদ্ধারা ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, সেখানেই তারা গান শুনিয়ে নতুন প্রাণ জুগিয়েছেন।

আর অভিনয় শিল্পীরাও পিছিয়ে ছিলেন না

ঢাকার ভাঙাচোরা শহরে, পাকিস্তানি সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে— অনেক শিল্পী মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দিয়েছেন, লুকিয়েছেন, সাহায্যের টাকা তুলেছেন। সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন শব্দের বুলেট, গীতিকার ও কবিরা লিখেছেন সংহতির গান।

নারী নির্যাতন— অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকা হাজারো ‘যোদ্ধা’

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আলবদরদের হাতে নারীরা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু তারা ভেঙে পড়েননি— বরং যুদ্ধশেষে দেশের পুনর্গঠনে কাজ করেছেন, পরিবার গড়েছেন, সন্তানকে বড় করেছেন। তাদের দৃঢ়তা, মানসিক শক্তি—এটাও এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতারই অংশ।

১৬ ডিসেম্বর যখন বিজয়ের পতাকা উড়ল, তখন শুধু বন্দুকধারী যোদ্ধারাই বিজয়ী হননি। বিজয়ী হয়েছিল সেই— মা, যে ভাত রান্না করে রেখেছিলেন। কিশোরী, যে গোপন বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। সেবিকা, যার হাতে শত শত যোদ্ধা নতুন জীবন পেয়েছিল। শিল্পী, যে গান শুনিয়ে মনোবল ফিরিয়ে দিয়েছিল। আর সেই অগণিত নারী, যাদের ত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীনতা।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নারীরা ছিল ইতিহাসের নীরব গর্জন… তারা না থাকলে ১৯৭১-এর বিজয়পতাকা আজ এত উঁচুতে উড়ত না। এই দেশ তাদের কাছে চিরঋণী।

বিজ্ঞাপন

আরো

সানজিদা যুথী - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর