Wednesday 10 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এসএমই ঋণের অপ্রাপ্তি
অলস ২৫ হাজার কোটি টাকা! নীতির সঙ্গে বাস্তবের সংঘাত

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)
১০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১১:৪১

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্প খাতকে উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই খাতের অর্থায়ন সহজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২৫ হাজার কোটি টাকার একটি বৃহৎ পুনঃঅর্থায়ন তহবিল চালু রেখেছে, যেখানে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার মাত্র ৭ শতাংশ। এই বিপুল পরিমাণ তহবিল থাকা সত্ত্বেও মাঠ পর্যায়ে ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণে অর্থায়ন স্থবির হয়ে আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা, ব্যাংকগুলোর সামর্থ্য ও অনীহা এবং উদ্যোক্তাদের কাঠামোগত দুর্বলতার মধ্যে কোথায় এই ফারাক সৃষ্টি হচ্ছে, সেই বিশ্লেষণ নিচে ধারাবাহিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তুলে ধরা হলো।

বিজ্ঞাপন

ব্যাংকগুলোর অনীহা: উচ্চ ঝুঁকি, পরিচালন ব্যয় ও মুনাফামুখীতা

২৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল অলস পড়ে থাকার মূল কারণ হলো ব্যাংকগুলোর উচ্চ ঝুঁকি এড়ানোর প্রবণতা এবং মুনাফামুখীতা, যা নীতিগত নির্দেশনার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করছে।

উচ্চ পরিচালন ব্যয়: ব্যাংকগুলোর কাছে একটি বড় করপোরেট ঋণ তদারকি করার চেয়ে শত শত ক্ষুদ্র এসএমই ঋণের ফাইল তৈরি ও প্রতিটি তদারকি করার খরচ অনেক বেশি। কম সুদের হার (৭ শতাংশ) এবং খেলাপি ঋণের ঝুঁকির কারণে এসএমই ঋণকে তারা কম লাভজনক মনে করে। ফলে, তারা কম পরিশ্রমে বেশি মুনাফা দিতে পারে এমন বড় গ্রাহকদের দিকেই বেশি মনোযোগী থাকে।

ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের ব্যর্থতা: ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করলেও, এটি পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবহার হচ্ছে না। জটিল প্রক্রিয়াকরণ, স্কিম সম্পর্কে ব্যাংক কর্মকর্তাদের অজ্ঞতা এবং দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ার আশঙ্কা এই কারণে ব্যাংকগুলো ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম সুবিধা এড়িয়ে যায়, যা ঝুঁকি নিরসনে ব্যর্থ হওয়ায় ঋণ বিতরণে অনীহা বাড়ায়।

ভৌগোলিক ও খাতভিত্তিক বৈষম্য: এসএমই ঋণ বিতরণ মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক প্রধান শহরগুলোতে কেন্দ্রীভূত। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের উদ্যোক্তা এবং কৃষিভিত্তিক বা স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী শিল্প খাতের জন্য ব্যাংকগুলো বিশেষায়িত ঋণপণ্য তৈরি করছে না, ফলে এই খাতগুলো ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

প্রথাগত ঋণ প্রক্রিয়া ও দক্ষতার অভাব: বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী তফসিলি ব্যাংকগুলোকে তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে দিতে হলেও, বাস্তবে বিতরণ হচ্ছে মাত্র ১৮ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম।

জামানত: নীতিতে ছাড়, বাস্তবে প্রধান বাধা

জামানতের বিষয়টিই ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে বিদ্যমান।
নীতিমালার দুর্বল প্রয়োগ: বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ৫ শতাংশের কম সুদে এবং জামানতবিহীনভাবে ঋণ দেয়ার বিধান রয়েছে। সামগ্রিকভাবে, একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত এসএমই ঋণ জামানতবিহীন হওয়া উচিত।

বাস্তবে জামানতের অনিবার্যতা: নীতিগত ছাড় থাকা সত্ত্বেও, বেশিরভাগ ব্যাংকই খেলাপি ঋণের ঝুঁকি কমাতে জামানতের প্রতি প্রবলভাবে নির্ভরশীল। তারা মনে করে, আইনি জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে জামানতবিহীন ঋণের অর্থ আদায় করা কঠিন। ফলে, ব্যাংকগুলো প্রজ্ঞাপনের চেয়ে নিজস্ব ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দেয়ায় জামানত এখন প্রধান এবং অপ্রতিরোধ্য বাধা হিসেবে কাজ করছে।

উদ্যোক্তাদের দুর্বলতা: অনানুষ্ঠানিকতা এবং নথিপত্রের ঘাটতি

ব্যাংকগুলোর অনীহা যেমন একটি কারণ, তেমনি ঋণ আবেদনকারী উদ্যোক্তাদের কাঠামোগত দুর্বলতা এবং নথিপত্রের ঘাটতিও ঋণ না পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশের প্রায় ৭৮ লাখ সিএমএসএমই প্রতিষ্ঠানের একটি বৃহৎ অংশই অনানুষ্ঠানিক খাতের। তাদের ব্যবসার নেই সঠিক ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট/ট্যাক্স নিবন্ধন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যথাযথ হিসাবের খাতা বা আর্থিক লেনদেনের রেকর্ড। আনুষ্ঠানিক নথিপত্র না থাকায় ব্যাংকগুলো তাদের ঋণযোগ্যতা যাচাই করতে পারে না।

ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের বিশেষ চ্যালেঞ্জ

অস্পষ্ট লেনদেন: ই-কমার্স এবং বিশেষ করে এফ-কমার্স উদ্যোক্তারা ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে লেনদেন করেন। তাদের ব্যবসার আর্থিক প্রবাহের কোনও আনুষ্ঠানিক প্রমাণ থাকে না। এই লেনদেনগুলো ব্যবসার আনুষ্ঠানিক অংশ হিসেবে গণ্য না হওয়ায় ব্যাংকগুলো তাদের বিশ্বাস করতে পারে না।

ডিজিটাল ক্রেডিট স্কোরিংয়ের অভাব: জামানতের বিকল্প হিসেবে এদের ডিজিটাল লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে ঋণ প্রদানের জন্য বাংলাদেশে এখনও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) ক্রেডিট স্কোরিং পদ্ধতি পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ফলে, এই ডিজিটাল উদ্যোক্তারা প্রচলিত ব্যাংকিং কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।

আর্থিক সচেতনতার অভাব: অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণের শর্তাবলী, সময়সীমা এবং ব্যাংক ঋণের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে পর্যাপ্তভাবে ওয়াকিবহাল নন। ফলে তারা সঠিক কাগজপত্র বা আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হন।

নীতিমালা ও প্রজ্ঞাপনের কার্যকর প্রয়োগে ঘাটতি

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত নীতিমালা কাগজে-কলমে এসএমই খাতের জন্য সহায়ক হলেও, এর যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় অর্থায়ন স্থবির হয়ে আছে।

নীতিমালার দুর্বল তদারকি: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো কেন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে, সে বিষয়ে যথেষ্ট তদারকি ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। যেসব ব্যাংক নির্দেশিত হারে ঋণ দিতে ব্যর্থ হয়, তাদের জন্য কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা প্রণোদনা না থাকার কারণে নীতিমালার উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না।

পুনঃঅর্থায়ন বিতরণের কৌশলগত সমস্যা: ২৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল থাকা সত্ত্বেও, ব্যাংকগুলো এই তহবিল পেতে যে শর্ত পূরণ করতে হয়, তাতে অনীহা দেখায়। এই তহবিল বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে সুনির্দিষ্ট ও সহজ কাস্টমাইজড পণ্য তৈরি করতে উৎসাহিত করা হয়নি।

এসএমই খাতের ২৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল অলস পড়ে থাকার বিষয়টি কেবল অর্থায়নের সমস্যা নয়, এটি নীতি, বাস্তবায়ন এবং মানসিকতার ত্রুটি। এই স্থবিরতা কাটাতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবশ্যই ঋণের জামানতবিহীন অংশকে বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য ঋণ বিতরণ না করার ক্ষেত্রে কঠোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে, সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল ট্রানজেকশনকে আনুষ্ঠানিক আর্থিক রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। কেবল তখনই এই অলস তহবিল গতি পাবে এবং দেশের অর্থনীতিতে সিএমএসএমই খাতের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

সারাবাংলা/এনএল/এএসজি
বিজ্ঞাপন

ময়মনসিংহ মুক্ত দিবস আজ
১০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১১:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর