বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট সংযোগের পেছনে একটি নীরব কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যের গল্প রয়েছে, যা খুব কমই আলোচনায় আসে। বৈদেশিক ঋণ বা বড় ধরনের সরকারি ভর্তুকির ওপর নির্ভর না করে, দেশের সাবমেরিন কেবল অবকাঠামো গড়ে ওঠেছে মূলত নিজস্ব আয়ে। এই কাজটি করেছে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলস পিএলসি (বিএসসিপিএলসি)।
২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠার পরপরই বিএসসিপিএলসি SEA-ME-WE-4 কেবলের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করে। শুরুতে সক্ষমতা ছিল মাত্র ৭.৫ জিবিপিএস। তবে দেশীয় টেলিকম অপারেটর ও ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীদের কাছে আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইডথ বিক্রি করে যে আয় আসতে থাকে, তা শুধু দৈনন্দিন কার্যক্রম চালানোর জন্যই নয়, ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের ভিত্তি হিসেবেও কাজে লাগে। ফলে জাতীয় কোষাগারের ওপর আলাদা চাপ না দিয়েই বিএসসিপিএলসি ধীরে ধীরে সক্ষমতা বাড়ানোর পথ তৈরি করে।
ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একক কেবলের ওপর নির্ভরতার ঝুঁকি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে নিজস্ব আয় পুন:বিনিয়োগ করে বিএসসিপিএলসি SEA-ME-WE-5 কনসোর্টিয়ামে যুক্ত হয়। এর মাধ্যমে দেশের আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইডথ সক্ষমতা এক লাফে কয়েক হাজার জিবিপিএসে পৌঁছে যায় এবং বিকল্প সংযোগের সুবিধা তৈরি হয়। এর সরাসরি সুফল পান গ্রাহকরা ইন্টারনেটের মূল্য কমে, গতি ও নির্ভরযোগ্যতা বাড়ে।
এই একই স্ব-অর্থায়নের নীতিতেই এগোচ্ছে সর্বশেষ প্রকল্প SEA-ME-WE-6। ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ চালু হওয়ার লক্ষ্য থাকা এই কেবল বাংলাদেশে প্রায় ৩৪ টেরাবিট প্রতি সেকেন্ড নতুন সক্ষমতা যোগ করবে। কক্সবাজার থেকে সিঙ্গাপুর, মুম্বাই ও ফ্রান্স পর্যন্ত বিস্তৃত এই সংযোগ দেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগে নতুন মাত্রা যোগ করবে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই প্রকল্পেও বড় ধরনের সরকারি ঋণ বা সার্বভৌম গ্যারান্টি নেয়া হয়নি।
এই অভিজ্ঞতা নীতিনির্ধারকদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হয়েও সুশাসন ও বাণিজ্যিক দক্ষতা থাকলে কৌশলগত ডিজিটাল অবকাঠামো স্বনির্ভরভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। একই সঙ্গে এটি ডিজিটাল স্বাধীনতা ও ডেটা সার্বভৌমত্বকে আরও শক্তিশালী করে, কারণ দেশের আন্তর্জাতিক সংযোগ অবকাঠামোর নিয়ন্ত্রণ দেশের হাতেই থাকে।
চতুর্থ সাবমেরিন কেবলের পরিকল্পনার সময়ে এসে দাঁড়িয়ে, বিএসসিপিএলসির এই পথচলা দেখিয়ে দেয় ডিজিটাল সক্ষমতা বাড়ানো শুধু প্রযুক্তির প্রশ্ন নয়, এটি আর্থিক শৃঙ্খলা ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফল। নীরবে, কিন্তু দৃঢ়ভাবে, এই প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশের ডিজিটাল সংযোগের মেরুদণ্ড গড়ে তুলেছে।
লেখক: টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী