২০১৭- বাধা ডিঙ্গিয়ে নারীর এগিয়ে চলার বছর
২৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৪:১৩
জান্নাতুল মাওয়া
সমগ্র পৃথিবীতে ধর্মীয় চরমপন্থার উত্থানের ঢেউ বাংলাদেশের গায়েও আছড়ে পড়েছে। সেই সাথে আছে আইনের শাসনের দুর্বলতার পাশাপাশি এই দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নানান সমস্যা। নারীপুরুষ নির্বিশেষে এই সমস্যাগুলোর শিকার হলেও যেহেতু আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক তাই এ দেশের নারীরা ভুক্তভোগী হচ্ছেন বেশি। তারপরও, ঘরে বাইরে নানা সমস্যার জাল কেটে কেটে এদেশের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন দৃপ্ত পদক্ষেপে। বছরজুড়ে চলা বিভিন্ন জরিপ আমাদেরকে এমন তথ্যই দেয়।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রদত্ত “দ্যা গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৭” অনুযায়ী নারী আর পুরুষের মাঝে বিভাজনের ক্ষেত্রে বিশ্বের ১৪৪ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭। গত বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ৭২। অর্থাৎ এই একটি বছরে বাংলাদেশের নারীরা ২৫ ধাপ এগিয়ে গেছে! শুধু তাই নয়, লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার বাকি সবকটি দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। এই তথ্যটি আমাদের দেশের নারীদের মনোবল বাড়িয়ে আরও সামনে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা জাগাবে।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাথমিকে দেশে ৫১ শতাংশ ছাত্রী পড়াশোনা করছে। এ স্তরে ছাত্রসংখ্যা ছাত্রীদের থেকে ২ শতাংশ কম। মাধ্যমিক স্তরে গিয়ে ছাত্রীসংখ্যা একটু বেড়ে ৫৩ শতাংশ। কিন্তু কলেজ পর্যায়ে যেয়ে আবার ছাত্রী সংখা কমে গিয়ে মাত্র ৪৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এসব তথ্য থেকে একটা জিনিস বোঝা যায় যে প্রাথমিক পর্যায়ে ছেলে শিশুদের তুলনায় মেয়ে শিশুরা বেশি ভর্তি হলেও উঁচু ক্লাসে উঠতে উঠতে মেয়ে শিক্ষার্থিদের হার কমতে থাকে। তবে মাদ্রাসা শিক্ষায় আবার ছাত্রের তুলনায় ছাত্রী বেশি (৫৪ শতাংশ)। এ ছাড়া প্রফেশনাল শিক্ষায় ৩৯ শতাংশ, শিক্ষক শিক্ষায় ৩৪ শতাংশ ও কারিগরিতে ২৪ শতাংশ নারী লেখাপড়া করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, বর্তমানে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ নারী আছেন। দেশে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১০ লাখ ৯৬ হাজার ৩৩৪টি। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮৩ হাজার ১৩৩ জন। ১৯৭৪ সালে কর্মক্ষেত্রে নারী ছিল ৪ শতাংশ, এখন তা বেড়ে ৩৩ শতাংশ হয়েছে।
গত নভেম্বর মাসে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ১০৬ জন নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যা মোট সংখ্যার ২৫ শতাংশ। সরকারের জনপ্রশাসনে ৭৮ টির মাঝে ১০ টি পদে দশজন নারী সচিব হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। ৬ জন নারী জেলা প্রশাসক এবং ১৬ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভিন্ন জেলায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দেশে প্রশাসন ক্যাডারে কর্মরত ৫৭৫৯ জনের মধ্যে ১১০০ জন নারী রয়েছেন। যদিও পুরুষ কর্মকর্তাদের সংখ্যার বিবেচনায় এ সংখ্যা এখনো বেশ নগণ্য তবুও সংখ্যাটি ক্রমবর্ধমান যা বেশ আশাব্যঞ্জক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের পাঁচ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে এক কোটি ৬২ লাখ নারী। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৯৭ জন। বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্পের ৮০ শতাংশ কর্মীই নারী। আর দেশের ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহারকারীও নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী গত চার বছরে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
এদিকে গত ৭ ডিসেম্বর কঙ্গোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে প্রথমবারের মত দুজন নারী পাইলট হিসেবে যোগদান করেছেন। দুর্গম ও ভিন্ন পরিবেশে শান্তিরক্ষার এই কাজটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন বিমান বাহিনীর পাইলট-ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হক এবং তামান্না-ই-লুত্ফী। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন্স বিমান বাংলাদেশে পাইলট রয়েছেন ১৪০ জন, এর মধ্যে নারী পাইলট ৯ জন। পুরুষদের মতো তারাও সাফল্যের সঙ্গে পালন করছেন পেশাগত দায়িত্ব।
যখন পুরুষ ফুটবল দল হিমশিম খাচ্ছে তখন নানান দেশে নিজ দেশের পতাকা সাফল্যের সাথে উড়িয়ে আসছেন বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। এইতো গত ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ অনুর্দ্ধ ১৫ নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতকে ১-০ তে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় যা দেশের জন্য সম্মান বয়ে নিয়ে এসেছে। এছাড়াও এবছর ফিফা র্যাঙ্কিং এ বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের অবস্থান সেরা ১০০ তে উঠে এসেছে, যেখানে পুরুষ ফুটবল দলের অবস্থান ২০০ ছুঁই ছুঁই।
তবে এবছরের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে নারীদের সাফল্য তেমন আশাপ্রদ নয়। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামীলীগের মনোনীত নারী প্রার্থী মেয়র পদে নির্বাচিত হননি। এই বিষয়টি নারীদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, সাফল্যের জন্যে তাদেরকে একাই দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে। গণমানুষ এখনো তাকে গৃহকোণে দেখতেই অভ্যস্ত। যদিও দেশে বিগত কয়েক দশক ধরে নারীরা নেতৃত্বে আছে তবে তাদের প্রায় সবাই পারিবারিকভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন।
গত মে মাসে নারী পাইলট তাসমিন দোজা যখন বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজে করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে যান কক্সবাজারে সেই অসাধারণ দৃশ্যটি আমাদেরকে বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। এখনো দেশে নারীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহন কিংবা চাকরি করতে চাইলে অনেক সময় পারিবারিক নির্যাতনের স্বীকার হন। তাদের জন্যে পথ সবসময়ই দুর্গম। এত কিছুর মাঝেও এদেশের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে দূর্বার গতিতে। একদিন সুলতানাদের স্বপ্ন পূরণ হবেই!
ছবিঃ ফারহানা ফারা
সারাবাংলা/আরএফ