Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও’


৫ আগস্ট ২০১৮ ০৯:৪২

।।ফারুক ওয়াহিদ।।

‘বন্ধু’ ছোট্ট একটি শব্দ- এই ‘বন্ধু’ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে কতো ছড়া, কতো কবিতা, কতো গল্প, কতো উপন্যাস-উপাখ্যান, কতো গান রচিত হয়েছে যা পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় বা সাহিত্যে রচিত হয়নি।

‘বন্ধু’ কি শুধু একটি শব্দ? ‘বন্ধু’ বা ‘বন্ধুরে…’ এই প্রিয় শব্দ বা শ্রুতিমধুর ডাকের মধ্যে কতো আন্তরিকতা রয়েছে সেটা অনুভবের বিষয়- ভাষায় বুঝানো সম্ভব নয়- এই বন্ধুত্ব কোনো নিক্তি দিয়ে মাপা সম্ভব নয় বা কোনো বইয়ের সংজ্ঞা দিয়ে বুঝানো সম্ভব নয়। এই সুন্দর মায়াবী পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ সম্পর্কের নাম ‘বন্ধুত্ব’- এই ‘বন্ধু’ শব্দের মাঝে মিশে আছে যেন অত্যন্ত নির্ভরতা আর আন্তরিক বিশ্বাস- বন্ধুত্ব হলো হৃদয়ের সবটুকু আবেগ নিংড়ানো ভালোবাসা এবং মন খুলে অব্যক্ত সুপ্ত জমানো কথা বলা- এ যেন রক্তের সম্পর্কের চেয়েও শক্তিশালী কোনো বাঁধন। বন্ধুকে ভালোবাসা দিয়ে বা আদর সোহাগ করে কতো কতো নামে ডাকা হয়- সখা, সখী(বান্ধবী), সই, প্রিয়া আরও অনেক নামে। নজরুল সংগীতে আছে- “সই ভালো করে বিনোদ বেণী বাঁধিয়া দে”। কবি’রা সখী(বান্ধবী) বা প্রিয়াকে নিয়ে কতো কিছু কল্পনা করে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়ে তুলেন- কবি নজরুল ঠিক এভাবেই তাঁর প্রিয়াকে সাজিয়েছেন যা অতুলনীয়- পৃথিবীর আর কোনো কবি কি পারবেন তার প্রিয়াকে এভাবে সাজাতে?-

“মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী,
দেব খোঁপায় তারার ফুল।
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির,
চৈতী চাঁদের দুল।
কণ্ঠে তোমার পরাবো বালিকা,
হংস-সারির দুলানো মালিকা।
বিজলী জরীণ ফিতায় বাঁধিব,
মেঘ রং এলো চুল।
মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী,
দেব খোঁপায় তারার ফুল।
জ্যোৎস্নার সাথে চন্দন দিয়ে
মাখাব তোমার গায়,
রামধনু হতে লাল রং ছানি,
আলতা পরাব পায়।
আমার গানের সাত-সুর দিয়া,
তোমার বাসর রচিব প্রিয়া।
তোমারে ঘেরিয়া গাহিবে আমার,
কবিতার বুলবুল।।
দেব খোঁপায় তারার ফুল।
মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী,
দেব খোঁপায় তারার ফুল।”

বিজ্ঞাপন

গ্রামবাংলায় মহিলাদের মধ্যে সই পাতা নিয়ে এখনো ঘটা করে কতো অনুষ্ঠান হয়- যেটা বাঙালি ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো জাতির মধ্যে আছে কি? রবীন্দ্রসংগীতে সখী-কে এভাবেই বলা হয়েছে- “ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে।” এই বন্ধু, সখা, সখী(বান্ধবী) ও সই নিয়ে বাংলা গান ও কবিতার উদাহরণ দিতে গেলে স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়, এটা মহাকাব্যকে ছাড়িয়ে যাবে।

গ্রাম-বাংলার কবি জসীমউদদীন আহমেদ ‘আমার বাড়ি’ কবিতায় বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেছেন এভাবে-

“আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব শালি ধানের চিঁড়ে।
শালি ধানের চিঁড়ে দেব,
বিন্নি ধানের খই,
বাড়ির গাছের কবরী কলা
গামছা বাঁধা দই।”

বন্ধু আসবে বন্ধুর বাড়িতে এর জন্য বাড়িতে সাদাসিধে আয়োজন অথচ এর মধ্যে যে কতো আন্তরিকতা রয়েছে তা বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জাতির মধ্যে আছে কি? তাই বাঙালি বন্ধুত্বের তুলনাই হয় না- বাঙালি বন্ধুর স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা চিরন্তন ও শাশ্বত- তাই এ ‘বন্ধু’ শব্দটির ব্যাপকতা ও ভালোবাসার বিশালতা অল্প কথায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

এই ডিজিটাল যুগে বন্ধুত্ব ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সাত সমুদ্র তোরো নদী পেড়িয়ে- সারা পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে- তাই বন্ধুত্বের পরিধি আজ বিশ্বময়- পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে একবন্ধু আরেক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ রাখতে পারছে। বিশ্ব বন্ধু দিবস উপলক্ষে দেশ-বিদেশের সকল শুভাকাঙ্ক্ষী ও শুভানুধ্যায়ী বন্ধুদের প্রতি বিশেষ করে বাঙালি সুহৃদ বন্ধুদের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও আন্তরিক শুভেচ্ছা- শুভ হোক বন্ধু দিবস। বন্ধু দিবসে বাংলার সেই সব বন্ধুদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি- যাঁরা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে মাতৃভূমি তথা বাংলা মা’কে উদ্ধার করার জন্য হানাদার বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শুধু একদিনেই চোখের সামনে আমার পাঁচজন সহযোদ্ধা বন্ধুকে চিরদিনের জন্য হারিয়েছি- বন্ধু দিবসে আজ কীভাবে ভুলবো এইসব সহযোদ্ধা বন্ধুদের?

বিজ্ঞাপন

১৯৩৫ সালে মার্কিন কংগ্রেস ঘোষণার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর আগস্ট মাসের প্রথম রবিবার বিশ্ব বন্ধু দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। বন্ধুত্বের জন্য যদিও আলাদা কোনো দিনের প্রয়োজন হয় না- বন্ধু দিবস হচ্ছে বন্ধুকে বিশেষভাবে স্মরণ করার জন্য। বিশ্ব বন্ধু দিবস একটি সাংস্কৃতিক কৃষ্টি ও আনন্দঘন দিবস হিসেবে বন্ধুত্বের গুরুত্ব বা মূল্যায়নের জন্য এই বিশেষ সম্পর্ককে সম্মান প্রদর্শনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও উদযাপিত হচ্ছে।

বন্ধুত্বের প্রথম শর্ত হচ্ছে ভালোবাসা। মানুষ সামাজিক জীব- বন্ধু ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না- বন্ধুত্বের স্বাদ অমলিন তাই বন্ধুহীন কোনো মানুষই সুখী হতে পারে না। যাদের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী বন্ধু আর বন্ধুতা- তারা এক মুহূর্তের জন্যও মন থেকে আড়াল করতে পারেন না বন্ধুদের- জীবনের সংকটে এরা মুহূর্তে ছুটে যান বন্ধুদের কাছে। বাঙালির বন্ধুত্বের বৈশিষ্ট্যই আলাদা। বাঙালি বন্ধুর হাত ধরেই বড় হয়- একসঙ্গে ভালোবাসা শেখে- সংগ্রামের বজ্রকঠিন শপথ নেয়- একাত্তরে এক বন্ধু আরেক বন্ধুর হাত ধরেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে এবং বন্ধুর হাতে হাত রেখেই বাংলা মায়ের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে।

বন্ধুত্বের প্রকৃতপক্ষে কোনো বয়স সীমা নেই- বয়সে ছোট-বড় যে কেউ বন্ধু হতে পারে- তবে ছোটদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা আর বড়দের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা থাকতেই হবে তা নাহলে বন্ধু কীসের? বন্ধু যে কেউ হতে পারে- এখানে ছেলেবন্ধু হতে পারে আবার মেয়েবন্ধুও হতে পারে- আবার স্বামী-স্ত্রী-সন্তারাও বন্ধু হতে পারে। এছাড়া স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালে, চাকরির ক্ষেত্রে সবখানেই বন্ধুত্ব হতে পারে- এমনকি শিক্ষার্থী-শিক্ষকও বন্ধু হতে পারে। বন্ধুত্ব ধর্ম ও জাতের বিচার মানে না, ধনী-গরিব মানেনা- সবচেয়ে বড় পরিচয় সে বন্ধু। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রেও বন্ধুত্ব হতে পারে যাকে আমরা বলে থাকি বন্ধু রাষ্ট্র- বাংলাদেশেরও অনেক বন্ধু রাষ্ট্র আছে। বন্ধুত্ব দেশ-মহাদেশের সীমানা মানেনা- বন্ধুত্ব নদী-সাগর-মহাসাগর-পর্বত-অরণ্য-মরুভূমি এমনকি আকাশ সীমানাও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না- সৃষ্টির শুরুতে বন্ধুত্ব ছিল, এখনও আছে এবং থাকবেও অনন্তকাল।

বন্ধু দিবসে বন্ধুত্বের আনন্দের প্রতীক ও প্রতিশ্রুতির প্রতীক হলুদ রঙের গোলাপফুল উপহার দেওয়া হয়- তাই এদিন হলুদ গোলাপফুলের কদর বা চাহিদা বেড়ে যায়- এছাড়া বন্ধুত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড(রিস্ট ব্যান্ড) উপহার হিসেবে দেওয়া হয় এবং এই ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড যাকে দেওয়া হয় সে সহসাই এটা খুলে রাখে না- এই ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড-এর প্রচলন এসেছে আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে যেটার প্রচলন এখনো রয়েছে- সেটার প্রতিফলনই এখন বিশ্ব বন্ধু দিবসে দেখা যায়- এটা কিছুটা বাঙালির প্রীতি বন্ধনের স্মারক সূত্র ‘রাখিবন্ধন’-এর মতো।

বন্ধুত্ব হলো হৃদয়ের সবটুকু আবেগ নিংড়ানো ভালোবাসা- মন খুলে হৃদয়ের অব্যক্ত সুপ্ত জমানো কথা বলা- বন্ধুকে আজীবন কাছে পেতে হলে প্রেম দিয়ে নয় বন্ধুত্ব দিয়ে আগলে রাখতে হবে, কারণ প্রেম একদিন হারিয়ে যেতে পারে কিন্তু বন্ধুত্ব কোনদিন হারায় না যা চির অটুট থাকে- তাই বন্ধু নির্বাচনে বেশ সতর্ক থাকতে হয়। বাংলায় একটি জনপ্রিয় প্রবাদ আছে- “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস/ অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।” ভালো সঙ্গী বা বন্ধুর অভাবে অনেক সময় কারো জীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারে তাই জীবনকে সুন্দরভাগে গড়ে তোলার জন্য সৎ সঙ্গী বা বন্ধু বেছে নিতে হবে এবং অসৎ সঙ্গী বা বন্ধুকে বর্জন করতে হবে- সত্যিকারের প্রকৃত বন্ধুর জন্য বন্ধুর মন কাঁদবেই- তাই বন্ধুত্ব হচ্ছে ডানা বিহীন ভালোবাসা এবং বন্ধুর বিকল্প বন্ধুই। শুধু বন্ধু দিবসে বন্ধুকে স্মরণ না করে প্রতিটি দিনই হোক বন্ধু দিবস এবং এই বন্ধুত্বের বাঁধন চির অটুট থাকুক এটাই হোক বিশ্ব বন্ধু দিবসের প্রত্যাশা।

“সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়/ অসময়ে হায় হায় কেহ কারো নয়।”- মানুষের সুদিনে অনেক বন্ধু জোটে, কিন্তু দুঃসময়ে প্রকৃত বন্ধু পাওয়া বড়ই মুশকিল। বাংলার সুযোগ সন্ধানী বন্ধুদের থেকে সাবধান থাকতে হবে এবং এ ধরনের বন্ধুদের সঙ্কটের সময় বা দুর্দিনে খুঁজে পাওয়া যায় না- তাই তাদেরকে ‘বসন্তের কোকিল’-এর সাথে তুলনা করা হয়েছে- দোষ দেওয়া হয়েছে ঋতুরাজ বসন্তের সময় সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী বেচারা বাংলার বসন্তের কোকিলদের।

‘বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু’- তাই বিশ্ব বন্ধু দিবস উপলক্ষে অত্যন্ত গর্ব ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিপদের দিনের প্রকৃত বন্ধু মিত্রবাহিনীকে যারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন- এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বিদেশি সম্মানিত বন্ধুদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং বিশ্ব বন্ধু দিবসে এই মুহূর্তে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া বিখ্যাত আবেগময় গানটির কথা বার বার মনে পড়ে যায়-

“বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও
মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও
ভুলো না তারে ডেকে নিতে তুমি।।
বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও
খুশির খেয়ালে পাল তুলে যেও চিরদিন
হাসি আর গানে শোধ করে যেও যত ঋণ
স্মৃতির পটেতে যত ব্যথা আছে ভুলে যেও।
ভুলো না তারে ডেকে নিতে তুমি।
বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও
মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও
সমুখে রয়েছে পথ চলে যাও চলে যাও
পিছনে যা কিছু টানে ফেলে যাও
ফেলে যাও সমুখে রয়েছে পথ চলে যাও চলে যাও
পিছনে যা কিছু টানে ফেলে যাও ফেলে যাও
আলোর পরশে ভোর হয়ে যাবে এই রাত
কোন দিন ভুলে ছেড়ো নাক তুমি এই হাত
ভুল হারানো দিনে তাকে তুমি সাথে নিও।
ভুলো না তারে ডেকে নিতে তুমি।
বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও
মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও
ভুলো না তারে ডেকে নিতে তুমি।
বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও
মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও
ভুলো না তারে ডেকে নিতে তুমি।
বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও।”

 

সারাবাংলা/এমএ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

দেশে ফিরেছেন প্রধান উপদেষ্টা
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:৫০

সম্পর্কিত খবর