Monday 07 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

[পর্ব -২ ] এ কেমন খেলা?


১৬ আগস্ট ২০১৮ ০৮:৫৯ | আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০১৮ ০৯:০২
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শুরুর কথা

দেশের স্বনামধন্য একটি মানবাধিকার সংস্থায় প্রায় ১৬ বছর কাজ করেছি। নারীদের সমস্যা আর তাদের জীবন খুব কাছ থেকে দেখবার সুযোগ হয়েছে আমার। কেউ এসেছে আইনগত সাহায্য চাইতে, কেউবা আইনের সহযোগিতা নয় শুধুমাত্র নিজের কষ্টের কথাটা বলে হাল্কা হতে চেয়েছে।

চেষ্টা করেছি তাদের চাওয়াটাকে প্রাধান্য দিয়ে সহায়তা করতে। মধ্যস্থতার কাজটি আমার দায়িত্বের মধ্যে ছিল। পারিবারিক যে সমস্যাগুলো শুধুমাত্র মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য এবং যে নারী মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধান চাইতো তাকে সেইভাবেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি।

সব সমস্যার যে মধ্যস্থতায় সমাধান করতে পেরেছি তা নয়! সেক্ষেত্রে আদালত অব্দি গড়িয়েছে। আমার দায়িত্বের জায়গা থেকে আমি কতটা সফল তা জানিনা। তবে মধ্যস্থতার এ কাজটা খুব নিষ্ঠা, সততা ও আবেগ দিয়ে করেছি। যার কারণে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আসার পরও শুনি ‘আপনার সালিশের জন্যই আমরা আজও ভাল আছি।’

বিজ্ঞাপন

সেই নির্যাতিত আর সংসারে অবহেলিত নারীটি যখন এ কথা বলে তখন একজন মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবী হিসেবে নিজেকে সফল মনে হয়। আর ভাললাগায় ভরে ওঠে মনটা। যেসব নারী তাদের কষ্টের সময় সংস্থায় আসত সহায়তার  জন্য সেইসব কষ্ট আর বেদনায় সিক্ত জীবন কাহিনীগুলো (নাম পরিচয় গোপন রেখে) ‘সারা বাংলার’ এই কলামে নিয়মিত লিখবার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। হয়ত তাদের জীবনের গল্পগুলো মিলে যেতে পারে আমার আপনার জীবনের সাথে। 

 

লাবণীর গল্প

‘আমি লম্বায় খাটো- আমার চেহারা ভালো নয়- এই কি আমার অপরাধ? আমার বিয়ে হয়না- এই আমার দোষ?

প্রশ্ন করে অবাক চোখে তাকায় লাবণী (ছদ্মনাম)।

– আপা বলেন তো আমি কি করি? আমি শিক্ষিত রুচিশীল। আমার উদার আবেগী একটা মন আছে। ভালো কাজ করি এটা আমার কোন যোগ্যতা নয়। আমি কেন দেখতে ভাল না! কেন আমি পুরুষের চোখে সুন্দরী হতে পারিনা, এটাই আমার বড় দোষ!

একই মা-বাবার সন্তান আমি আর নবনী। আমরা দুই বোন। নবনী দারুণ সুন্দরী। ফর্সা-লম্বা-টানা গড়ন। মাসুমের সাথে দীর্ঘদিনের প্রেমের পরিণতিতে মহা ধুমধামে মা-বাবা বিয়ে দিল নবনীর। বাবা অনেক টাকা খরচ করলেন। আমার জন্য রাখা গয়নাগুলো মা নবনীকে দিলেন। মাসুমের পরিবার যে অনেক সম্ভ্রান্ত! পাছে নবনীর অসম্মান হয়। আমার খারাপ লেগেছিল যে, গয়না দিয়েই কি নবনীর আত্মসম্মান মাপা হচ্ছে? নবনী মাসুমের সহপাঠী। তারা তো একই ডিগ্রি নিয়েছে। নবনী মেয়ে বলেই এত কিছু।
নবনী চাকরি করবে না। মাসুম মস্ত চাকরি করে- তাতেই হবে। তার শাশুড়ির মন্তব্য, ‘ মেয়ে মানুষের আবার চাকরি! সাজিয়েগুজিয়ে ঘরে থাক’।

নবনী মেনে নিয়েছে। মনে হয় সে তাতেই খুশি।

লাবণী বলে, আমি বড় দেখতে খারাপ।

তার জন্য আমার পরিবার নবনীকে আইবুড়ো করে রাখতে পারেনা। তাই বড় বোনের সামনেই ছোট বোনের বিয়ে হয়ে যায় পরিবারের সিদ্ধান্তেই। পুরো বাড়িতে লাবণী একা। বড় একা। মা-বাবা ব্যস্ত তাদের জীবন নিয়ে। লাবণী কাজ করে বাইরে। আর এখন যেন বেশি বাইরে থাকতেই ভাল লাগে। ঘর এখন তার জন্য অভিশাপ।
বড় চাচী বলে, তোর আবার পছন্দ কি? বুড়ো- ডিভোর্সী- বাচ্চার বাবা সে যাই হোক বিয়ে বলে কথা। এত বাছাবাছি করবি কেন? তোর কি আছে- চেহারা না ফিগার ?

একের পর এক ছেলের (পাত্র নামক) প্রস্তাব আসে। লাবণী সেজেগুজে তাদের সামনে যায়। ২/১ দিন পর জানাবে বলে প্রস্তাব নাকচ করে দেয় পাত্র পক্ষ। লাবণী যে তথাকথিত সুন্দরী নয়। সে দীর্ঘায়ী নয়- কালো। এ মেয়েকে বিয়ে করা যায় কি?

লাবণী বলে, আপা ভাবতাম এই জীবনে কেউ কি আমাকে ভালবাসে না? লাবণীর একটা সুন্দর মন আছে। যা দিয়ে লাবণী পৃথিবীর খারাপ দিকটা দেখতে পায়না। লাবণী একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করে।
কর্মক্ষেত্রেই পরিচয় হয়েছিল আরফানের সাথে। চোখে চোখে ভাললাগা। আরফান তাকে ‘লাইক’ করে একথা আরেক সহকর্মী বিপাশা প্রায়ই লাবণীকে বলতো। আরফানও জানাল লাবণীকে একদিন। লাবণী বিশ^াস করতে পারছিলো না। আমার মত খারাপ চেহারার একটা মেয়ের প্রেমে আরফানও পড়তে পারে। তারপরও আরফানকে দেখলেই কেন যে লাবণীর ভাল লাগে।

ভালোলাগা-ভালবাসা আর ঘর-বাড়ির স্বপ্নে বিভোর হয় লাবণী। আরফানও স্বপ্ন দেখাতে থাকে তাকে। একসময় দুজনের স্বপ্ন দেখাটা শুরু হয়ে যায়। মানে প্রেমে পড়ে লাবণী। আরফান বিয়ের প্রস্তাব দেয়। লাবনীর বিশ্বাস হতে চায়না। লাবণী দীর্ঘায়ী নয়, বরং সকলের তুলনায় একটু খাটোই বলা যায়। আরফানের মত একটি সুদর্শন ছেলে তাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে? তবে আরফানের কথায় আশ্বস্ত হয় লাবণী। বিয়ের প্রস্তাব আসে আরফানের পরিবার থেকে। লাবণী খুশি, আর খুশি তার পরিবার।
লাবণীর বিয়ে হবে। সে যত বড় চাকুরে হোক না কেন, বিয়ে তো হচ্ছে। আত্মীয়স্বজনের মুখে মুখে এ কথা। এত খাটো মেয়েকে কে বিয়ে করবে। বাপের ঘাড় থেকে তো বোঝা নামছে। লাবণী কথাগুলো শুনে কষ্ট পায়। তারপরও ভাবে, ঠিকই তো। আমি তো বোঝাই।

আরফানের পরিবার আসবে আংটি পড়াতে। দিন ঠিক হবে বিয়ের। বাসায় আয়োজন চলছে। লাবণী আজ অনেক সেজেছে। আয়নার সামনে নিজেকে অনেক সুন্দর লাগছে। আরফানকে স্বামী হিসেবে পাবার আনন্দে ব্যাকুল হয় লাবণী।

লাবণী বলে, জানেন আপা এ দিনটা যেন ফুরাচ্ছিল না। সকাল থেকে কতবার যে আরফানকে ফোন করেছি। সন্ধ্যায় তার পরিবার আসবে। দিন ঠিক হবে। আনন্দে আমি যেন ভাসছিলাম।

বলতে বলতে লাবণীর চোখে জল আসে। জানেন বিকেল থেকে আরফানের ফোন বন্ধ। কোনভাবেই কন্টাক্ট করা যাচ্ছিল না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সবাই চলে যেতে থাকে। এমনকি আরফানের বাবা কিংবা পরিবারের আর কোন সদস্যকেই ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। লাবণীর বুঝতে বাকি থাকে না। আরাফান আসবে না। বিয়েটা ভেঙ্গে যায়।

দুই-পাঁচদিন পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত লাবণী অফিসে যায় আর জানতে পারে সহকর্মী সুন্দরী বিপাশাকেই আরফান ঐদিন বিয়ে করেছে।

এ কেমন খেলা! লাবণী আবার কষ্টটা বুকে চেপে বসে।

কিচ্ছু কি করার নেই? প্রতারক, ভন্ড আর সুযোগ সন্ধানী এই মানুষটির বিরুদ্ধে? লাবণী জানতে চায়।

না, কোন আইন নেই যা দিয়ে আমি লাবণীকে সাহায্য করতে পারি।

লাবণী বোঝে আর বলে, আপা আমার যথেষ্ট রূপ নেই যা আরাফানকে আকৃষ্ট করতে পারে। যার কারণেই লাবণীর সরলতার সুযোগ নিয়ে আরফান এ খেলা খেলেছে। লাবণী চাকরি ছেড়ে দেয়। আরফানের মুখোমুখি হওয়ার মত মানসিক দৃঢ়তা লাবণীর সেসময় ছিলনা।

সময়ের নিয়মেই সময় গড়ায়। জীবন চলে জীবনের গতিতে। লাবণী আবার নতুন চাকরি পায়। আবার লাবণীর পথ চলা শুরু হয়। এবার নতুন চাকরিতে উচ্চ বেতন-উচ্চ পদ- গাড়ি।

লাবণী এখন ভালো আছে। দৃঢ় মনোবলে লাবণী এগিয়ে চলছে জীবনের পথে।

 

 

নাহিদ শামস্- আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী

 

 

সারাবাংলা/এসএস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর