কবিগুরুর ‘ক্যামেলিয়া’র জন্মঘর বলধা গার্ডেন
৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৩:২৮
।।এসএম মুন্না ।।
তখনও আজকের মতো আধুনিক চেহারা পায়নি এই ঢাকা নগরী। খাল-বিল, দীঘি-নালা আর পুকুরে ভরপুর। বিশুদ্ধ খাবার পানির সরবরাহের উন্নত ব্যবস্থা না থাকায় পানির জন্য প্রতি বাড়িতেই তখন খনন করা হতো পুকুর কিংবা ইঁদারা বা কূপ। কেউ আবার নিজের বাগান বাড়িতে শখের বশেও খনন করতেন পুকুর বা দীঘি।
ওই সময় এমনই শতাধিক পুকুরের অস্তিত্ব ছিল এই ঢাকায়। আজ নেই বললেই চলে। যে কয়টি আছে সেগুলোও আবাসন সঙ্কট ও ভূমিদস্যুদের কবলে পড়ে বিলীন হতে বসেছে। তবে এখনও টিকে আছে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর হাতে গড়া পুকুর ‘শঙ্খনদ’। গাজীপুরের বলধার এই জমিদার ঢাকার ওয়ারীতে তার বাগান বাড়িতে (বলধা গার্ডেন) গড়ে তুলেছিলেন এই পুকুরটি।
মার্বেল পাথরের শান বাঁধানো দৃষ্টিনন্দন পুকুরটি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। এরই উত্তর-ঘাটে শূণ্যে জমিদার নারায়ণ রায় চৌধুরী নিজ এবং পরিবার-পরিজনের আরাম-আয়েশের জন্য গড়ে তোলেন ‘জয় হাউজ’। বাংলায় আনন্দ-ভবন।
রবীন্দ্রনাথ যখন ঢাকা দর্শনে আসেন তখন তিনি এই বলধা গার্ডেনেও ঘুরে যান। শঙ্খনদের ধারে ক্যামেলিয়া ফুলের সৌন্দর্যে মুদ্ধ হয়ে কবি জয় হাউসে বসেই লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘ক্যামেলিয়া’- ‘‘নাম তার কমলা/ দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা/ সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।/ … জিগ্যেস করলেম ‘নাম কী’/ সে বললে, ক্যামেলিয়া …’’ কবিতাটি। বলধা গার্ডেনে রোপিত জাপান থেকে সংগৃহীত Camelia japonica ফুলের অপূর্ব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি লেখেন রবীন্দ্রনাথ।
১৯০৯ সালে বলধা প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। ‘সাইকি’ ও ‘সিবিলি’ নামে দুইটি বাগানের সম্মিলিত রূপ এই বলধা গার্ডেন। সাইকি অর্থ আত্মা ও সিবিলি অর্থ প্রকৃতির দেবী। সিবিলি অংশে জমিদার গড়ে তোলেন শঙ্খনদ পুকুরটি। বাগানের সাইকি অংশটি তার জমিদার বাড়িরই অংশ ছিল।
দেশ-বিদেশের দুর্লভ প্রজাতির নানা গাছ দিয়ে জমিদারের মনের মতো করে এই সাইকিকে গড়তে সময় লেগেছিল প্রায় ২৭ বছর। ১৯৩৬ সালে সম্পন্ন হয় সাইকির কাজ। কিন্তু এতেও তিনি তৃপ্ত হতে পারেননি। সাইকির বৈচিত্র্যে তুষ্ঠ হতে না পেরে তিনি সাইকির সঙ্গী হিসেবে সিবিলিকে গড়লেন। সাইকির উত্তর পাশেই লালমোহন সাহাদের বাগান বাড়ি। জমির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ২৫ একর। ১৯৩৬ সালে এটি কিনে নেন জমিদার নরেন্দ্র চৌধুরী। তখন সেখানে একটি ডোবা আর ‘সূর্যঘড়ি’ ছাড়া কিছুই ছিল না। ওই ডোবাটিকে ঘিরেই প্রায় এক বিঘা জমি নিয়ে তিনি পুনরায় খনন করেন পুকুর। নাম দেন ‘শঙ্খনদ’। জমিদার তার জীবদ্দশায়ই এই পুকুরে ফোঁটান দেশ-বিদেশের নানা রঙের পদ্ম ফুল।
খুব বেশিদিন আগের কথাও নয়, বছর দশেক আগেও পুকুরজুড়েই ছিল পদ্ম ফুল ও বিশাল বিশাল পদ্ম-পাতা। পুকুরের চারদিক জুড়ে দুর্লভ প্রজাতির দেশি-বিদেশি নানা ধরণের গাছ। পুকুরের উত্তর-দক্ষিন দিকে রয়েছে সেই নয়নাভিরাম ঘাট। বিভিন্ন রঙের মার্বেল পাথর দিয়ে শান বাঁধানো ঘাট, রাজা-বাদশাদের বসার আসনের মতো কারুকাজখচিত আসন বাড়িয়ে দিয়েছে ঘাটের সৌন্দর্য। এখনও প্রতিদিন দর্শনার্থীরা আসেন ঐতিহ্যবাহী শঙ্খনদ পুকুর, জয় হাউস ও এর ঘাটের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। তবে পুকুরের পানির সেই টলটলে ভাবটি এখন আর নেই। পানি নোংরা হয়ে গিয়েছে। নেই নান্দনিক সেই সৌন্দর্যের পদ্ম-ফুল। তবে জয় হাউসটি রঙ করে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে।
১৯০৯ সালের দিকে গড়ে ওঠা এই গার্ডেনটি ঢাকার উচ্চবিত্তদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। নিয়মিত সেখানে বসতো গান-বাজনার আসর। ধারণা করা হয় বলধা নাম থেকেই বলধা গার্ডেনের নামকরণ হয়েছে। জমিদার নারায়ণ চন্দ্র চৌধুরী ৫০টি দেশ থেকে নানারকম ফুলগাছ ও অন্যান্য উদ্ভিদ এনে রোপণ করেছিলেন। বলধা গার্ডেন প্রকৃতপক্ষে ফুল ও উদ্ভিদের একটি মিউজিয়াম। তবে সত্যিকারের একটি মিউজিয়ামও ছিল বলধা গার্ডেনে। তাতে কয়েকটি ধাতব মূর্তি ছিল। এখন এসব অতীত।
বলধা গার্ডেনে যেমন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উদ্ভিদ রয়েছে ঠিক তেমনি দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান লোকরা বলধা গার্ডেন দেখতে আসতেন। এখনও বলধা গার্ডেন নিয়ে ঢাকাবাসীর আগ্রহের কমতি নেই। ১৯২৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বলধা পরিদর্শনে আসলে নোবেলজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিশেষ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সফরে আসলে অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনকেও সংবর্ধনা দেওয়া হয় বলধা গার্ডেনে।
বলধায় রয়েছে নানা প্রজাতির উদ্ভিদসম্ভার। যেমন- সাত প্রকারের বিরল প্রজাতির অর্কিড, ক্যাকটাস, জলজ উদ্ভিদ, দেওয়াল লতা, বাসর লতা, বৃক্ষলতা ও বিবিধ গাছ-গাছালি। ৮৭টি উদ্ভিদ পরিবারভুক্ত ৩৩৯টি জেনারের ৬৭২ প্রজাতির প্রায় ১৮ হাজার নমুণা। এর বেশিরভাগই বিদেশি ও প্রায় দুষ্পাপ্য। বাগানের অন্যতম আকর্ষণ ‘সেঞ্চুরি প্লান্ট’। ফোটে একশ বছর পর। ‘বাওবাব’ গাছটির ঐতিহাসিক মূল্য আছে। মধ্য-আফ্রিকার আদিবাসীরা মিশরের ফারাওদের অনেক আগে থেকেই এই গাছের খোঁড়লে মৃতদেহ রেখে মমি বানাত।
সিবিলি অংশের গোলাপ বাগান নানাজাতের গোলাপের সমৃদ্ধ সংগ্রহের জন্য গোটা উপমহাদেশে বিখ্যাত। দুটি গ্রীনহাউসের একটিতে আছে বহু প্রজাতির অর্কিড, কচুজাতীয় ঔষধি ও ছায়াপছন্দ গাছপালা। বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ সঠিকভাবে সংরক্ষণের জন্য এখানে আছে চারটি করজারভেটরি হাউস। এগুলো হলো-ফার্ন হাউজ, অ্যালো হাউস, অর্কিড ও ক্যাকটাস এবং ক্যামেলিয়া হাউজ। বলধায় আমাজান লিলির পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় ফুল সাদা শাপলাসহ ১২ প্রজাতি শাপলা ফুল ফোটে।
জমিদার নারায়ণ রায় চৌধুরীর ঐকান্তিক ইচ্ছায় এই বলধা গার্ডেন প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই মহান ব্যক্তির সমাধিও রয়েছে এখানে। সিবিলি ও সাইকি অংশের মধ্যে সিবিলি অংশ প্রতিদিন সকাল ৮ থেকে দুপুর ১টা ও দুপুর ২ টা হতে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। সাইকি অংশটি সংরক্ষিত। বর্তমানে বলধা গার্ডেন বাংলাদেশ সরকারের বনবিভাগের অধীনে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের একটি স্যাটেলাইট ইউনিট।
ছবি : হাবিবুর রহমান
সারাবাংলা/পিএম