‘ওই, মহিলা তুলিছ না’
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১১:৩৫
সিরাজুম মুনিরা নীরা ।।
গত সাড়ে সাত বছরের ঢাকা জীবনে আমার সর্বাধিক শোনা বাক্য কোনটা জানেন? বাক্যটা হল – ‘ওই মহিলা তুলিছ না’। যে কথাগুলো আমি শুনতে ঘৃণা করি এটি তার মধ্যে অন্যতম।
এই বাক্য শুনলে মনে হয়, নারীরা কোনো গা ঘিনঘিনে জীব, যারা বাসে উঠলে অন্য যাত্রীদের গায়ে ময়লা লেগে যাবে। কিংবা মনে হবে অচ্ছুৎ কোনো গোষ্ঠীর সদস্য আমি, সাহেব-বাবুদের সঙ্গে এক বাসে চড়ে নিজের বাড়িও ফিরতে পারবো না।
আমি একজন চাকরিজীবী নারী। তথাকথিত মধ্যবিত্ত, যাকে প্রতিটা পয়সা হিসাব করে খরচ করতে হয়। সঙ্গত কারণেই নিজের কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের জন্য আমাকে খুঁজে নিতে হয় অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী এবং দ্রুতগামী বাহনটি। ঢাকা শহরে যার গালভরা নাম আছে, গণপরিবহণ।
তো সেই লোকাল বা পাবলিক বাসে চেপে রোজ বাসা থেকে অফিস যাই আমি। আমার বাসা শ্যাওড়াপাড়া। আর বর্তমান কর্মক্ষেত্র পল্টন। যেহেতু সাংবাদিকতা করি তাই ৯টা-৫টা অফিসের প্যারা নেই আমার। একেকদিন একেক সময় অফিস।
যেদিন সকাল ৮টায় শিফট শুরু হয় সেদিন ঠিক ৭টায় বাসে উঠতে পারলেই সময় মতো অফিসে ঢুকতে পারি। পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গেলে শ্যাওড়াপাড়া থেকে আর বাসে ওঠাই যায় না। যে বাসগুলোতে খানিকটা দাঁড়ানোর জায়গা থাকে সেগুলো ‘মহিলা’ তোলে না। ফলে প্রায় দিনই দৌড়ে চালকের সহকারির শার্ট খামচে বাসে উঠতে হয় আমাকে।
যেদিন ১০টার পরে বের হই সেদিনও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয় না। কেবল দুপুরে মানে ১টার পরে হয়তো সিট নিয়ে বসে অফিসে আসতে পারি।
অফিস শেষে ফেরার পথে শুরু হয় আরেক বিড়ম্বনা। চারটার পর পল্টন মোড়ে মিরপুরগামী কোনো বাসই নারী যাত্রী তুলতে চায় না। পুরুষদের চাপে জোর করে ওঠাও মুশকিল। দুই একটা বাস যারা নারী যাত্রী তোলে সেখানেও সহযাত্রীদেরই কটুক্তি শুনতে হয়। কেন ‘মেয়েমানুষ’ হয়ে এই ভরপুর বাসে উঠলাম? চালকের সহকারিকে রীতিমতো চ-বর্গীয় গালি শুনতে হয় পুরুষদের কাছ থেকে। তার অপরাধ যাত্রী ভর্তি বাসে ‘মেয়েমানুষ’ তুলেছে।
অনেকেই আবার নিয়ম কানুনের বেলায় খুব শক্ত। সিটিং সার্ভিস বাসে ‘মহিলা’রা কেন দাঁড়িয়ে যাবে? এই বলে একটা বাসের মধ্যে একটা আন্দোলন শুরু করে দেন তাঁরা। যেন পুরুষরা দুই পায়ে নয়, তাদের বিশেষ অঙ্গটি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর যেহেতু আমার বিশেষ ওই অঙ্গটি নেই, তাই আমি দাঁড়াতে পারবো না। অথচ প্রতিবাদ যদি করেন তাহলে করা উচিত সিটিং সার্ভিসের ভাড়া নিয়ে কেন দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে, তা নারী হোক বা পুরুষ।
আগে বেশিরভাগ দিনই বাসে আমার ঝগড়া লেগে যেত। বিষয়টা নিয়ে বাড়ির লোকজন, বিশেষত আমার মা খুব টেনশনে থাকেন। এখন প্রতিদিন বের হওয়ার আগে বলে দেন, ‘মনে রেখ, তোমার একটা ছোট বাচ্চা আছে। ওর কথা ভেবে হলেও কোথাও ঝামেলা কোরো না’।
মাতাশ্রীকে তথাস্তু বলে বেরিয়ে আসি। বহু সংগ্রাম করে বাসে উঠি আর সেই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়ের চিত্র দেখি।
আজকাল রাগি না। ঠাণ্ডা মাথায় মুখে মিষ্টি হাসি দিয়ে জবাব দেই। কেউ যখন বলে, এতো ভিড়ের বাসে মহিলা উঠানো হল কেন? সিট কই?
মিষ্টি হেসে জবাব দিই, আমি কী আপনার কাছে সিট চেয়েছি? না আপনার কোলে বসতে চেয়েছি?
প্রশ্নকর্তা বলেন, কীভাবে দাঁড়িয়ে যাবেন?
বলি, যেভাবে অন্যরা দাঁড়িয়ে আছে সেভাবে। নিজের দুই পায়ের ওপর ভর দিয়ে।
আবার প্রশ্ন আসে, এভাবে যাওয়া কষ্ট না? একটু দাঁড়ালেই খালি বাস পেতেন।
এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলি, আপনি বাস পাঠাবেন? কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে? কাল সকাল পর্যন্ত দাঁড়ালে চলবে?
এরপর প্রশ্নকর্তা এবং অন্য সহযাত্রীরা নিজে নিজে গজ গজ করতে থাকেন যে, আজকাল কারো ভালো চেয়ে লাভ নাই। মহিলারা বেশি বোঝে!
এর বাইরেও বহু দিন থাকে যেদিন কোনোভাবেই বাসে ওঠা যায় না। তখন পল্টন থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট থেকে আরেক বাসে কচুক্ষেত এবং সেখান থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত লেগুনায় করে বাসায় পৌঁছতে হয়। এ রকম সময় আমি ভূতগ্রস্তের মতো পথ চলি। শুধু বাচ্চাটার চেহারা সামনে ভাসে, তাই এতো ঝামেলা করে, বাসের পর বাস বদলে বাড়ি ফিরি।
এতক্ষণ লেখা পড়ে যাদের মন আর্দ্র হয়েছে তাদের বলি, রসুন, কাহিনী এখনো বাকি আছে। এতোক্ষণ যা পড়লেন সব হচ্ছে খুব স্বাভাবিক যুদ্ধ। এটা ঢাকার পথে বের হওয়া প্রতিটা মেয়েকেই কমবেশি করতে হয়।
একদিনের ঘটনা বলি। তখন মাত্র ঢাকায় এসেছি। অফিস শেষে কারওয়ান বাজার থেকে বাসে উঠেছি। প্রচুর ভিড়, দাঁড়িয়ে আছি। পাশের যাত্রী, বয়স আমার কমই হবে, বার বার গা ঘেঁষছেন। আমি বিরক্ত হয়ে সরে দাঁড়াচ্ছি। বিষয়টা উল্টোদিকে বসা দুই পুরুষযাত্রীও খেয়াল করেছেন। এর মধ্যে হঠাৎ মনে হলো শরীরের পেছনের অংশে শক্ত কিছুর খোঁচা লাগছে। একটু পর বুঝতে পারলাম ওটা ওই ব্যক্তির উত্থিত বিশেষ অঙ্গ, যা আমার শরীরে মনের সুখে ঘষছেন তিনি। আমি ঘুরে একটা চড় লাগিয়েছিলাম। আর এটা হয়ে গেল আমার দোষ। পুরো বাসের নারী-পুরুষ আমার বিরুদ্ধে চলে গেলেন। মহিলা হয়ে পুরুষের গালে চড় মারলাম! কত সাহস আমার!
এ সময় বাঁচালেন ওই দুই পুরুষ যাত্রী। যারা দেখছিলেন আমার বিরক্তি। তাদের সাক্ষ্য নিয়ে সেদিন বাসের মধ্যে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পেরেছিলাম।
সিটে বসলে পাশের যাত্রীর কনুই দিয়ে শরীরে খোঁচা খাওয়ার অভিজ্ঞতা সম্ভবত সব মেয়েরই আছে। আমার ভাবতে অবাক লাগে যে, আমার কনুই দিয়ে তার শরীরে খোঁচা লাগে না, তাহলে তারটা আমার লাগে কেন? উত্তরটা হলো- কেন আবার, তার ইচ্ছা হয় তাই।
এ নিয়ে কিছু বলাও যাবে না। তাহলে শুনতে হবে, বাসে উঠলে এরকম একটু গায়ে গা লাগে। এত সমস্যা হলে প্রাইভেট কারে কেন যাওয়া আসা করি না।
তার মানে, বাসে উঠলে কেউ আমার বুক ছুঁয়ে দিলে আমি তার প্রতিবাদ করতে পারবো না। বাসে উঠেছি মানে আমি গণিমতের মাল হয়ে গেছি?
আবার সংরক্ষিত আসন বাদ দিয়ে সাধারণ আসনে বসলেও তেড়ে ওঠেন পুরুষরা। কারণ তারা তো মহিলা সিটে বসতে পারেন না। তাহলে মহিলারা কেন ‘পুরুষ’ সিটে বসবেন? সংরক্ষিত আসনগুলোও এতো সুন্দরভাবে ইঞ্জিনের ওপর বসানো থাকে যে সেখানে বসা আর ওভেনে বেকড হওয়ার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বিশেষ করে পিরিয়ড চলাকালে বিরাট পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে ওই লেডিস সিটে বসা যে কত বিড়ম্বনার, কত কষ্টের সেটা কাউকে বোঝানো সম্ভব না।
আর যদি গর্ভকালীন সময়ের বাস অভিজ্ঞতার কথা লিখতে যাই তাহলে উপন্যাস লিখে ফেলতে পারবো। শুধু এইটুকু বলি, পুরো আট মাস আমি বাসে যাতায়াত করেছি। পুরো সময়ে দুইদিন দুইজন পুরুষ আমার স্ফীত গর্ভ দেখে আমাকে বসার জন্য সিট ছেড়েছেন। তাছাড়া এই পুরো সময়ের অর্ধেকের বেশি আমি দাঁড়িয়ে অফিস গেছি। কোনো নারীও আমার জন্য আসন ছেড়ে দেননি, অন্তঃসত্ত্বা বোঝার পরেও! অনেকদিন অনেক বাসে উঠতে দেওয়া হয়নি গর্ভবতী হওয়ার অপরাধে।
থাক সেসব কথা, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?
লেখক- সাংবাদিক
সারাবাংলা/ এসএমএন/ এসএস