ল্যাট্রিনালিয়া: টয়লেট শিল্পকর্ম!
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১১:৪৯
।। আখিউজ্জামান মেনন ।।
ল্যাট্রিনালিয়া- যাকে বলা যেতে পারে টয়লেট শিল্প। যদিও একে শিল্প বলতে আপত্তি আছে অনেকের আর থাকবেই বা না কেন? ল্যাট্রিনালিয়া যে আগডুম-বাগডুম আর গালি-গালাজের আকরখনি। ল্যাট্রিনালিয়া সাহিত্য নাকি অপসাহিত্য সে বিষয়ে বিস্তর তর্ক থাকলেও লোকেদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে ল্যাট্রিনালিয়ার ভূমিকা অপরিসীম, সে-ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা একমত। টয়লেটের দেয়াল, দরজা, জানালায় লেখালেখি ও আঁকাআঁকিকে ল্যাট্রিনালিয়া বলে। খটমটে নামটা ১৯৬৬ সালে আমেরিকান ফোকলরিস্ট অ্যালান দুন্দের দেওয়া।
টয়লেট লেখালেখির একটা চমৎকার সংগ্রহ পাওয়া যায় ১৭৩১ প্রকাশিত হার্লো থ্রাম্বো ছদ্মনামে লেখা এক ইংরেজের বই থেকে। বইয়ের নাম সহজ তবে আকারে বড়- The merry-thought: or, the glass-window and bog-house. বিভিন্ন স্থানের বহু টয়লেট ঘুরেঘুরে ছদ্মনামের থ্রাম্বো বেশকিছু ল্যাট্রিনালিয়া সংগ্রহ করে। এক টয়লেট থেকে হার্লো টুকে আনে চমৎকার এক ‘দার্শনিক’ প্রশ্ন- Good Lord: Who could think that such fine folks should stink? আরেক টয়লেটে গিয়ে হার্লো থ্রাম্বো আবিষ্কার করেন ইতিহাসের সকল মহান রাজাকে নিয়ে জনৈক ব্যক্তির এক শ্লেষাত্মক ঘোষণা- যুদ্ধের সময় রাজাকে যত মহান দেখায়, প্রাকৃতিক কাজ সাড়ার সময় তাকে আমার মতো ওতো মহান দেখায় না। Hampstead-এর এক টয়লেটে ঢুকে হার্লোর দেখা মেলে ভীষণ ‘বিপ্লবী’ এক লেখার সঙ্গে- There’s nothing foul that we commit, But what we write, and what we sh—t.
ল্যাট্রিনালিয়ার আরেক নাম আছে টয়লেট গ্রাফিতি। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিক হাসলাম তার বই ‘সাইকোলজি ইন দ্য বাথরুম’ এর একটা পরিচ্ছদের নাম দিয়েছেন- টয়লেট গ্রাফিতি। টয়লেট গ্রাফিতি পরিচ্ছদে হাসলাম বাথরুম লেখকদের মনস্তত্ত্ব ধরার চেষ্টা করেছেন। ‘When walls speak, what do they say’ শিরনামের একাডেমিক পেপারের উল্লেখ করে নিক হাসলাম টয়লেটে স্থান নেওয়া লেখালেখিকে মোট ১৪ ধরনে বিভক্ত করেছেন। যৌনতা, হাসি-ঠাট্টা, রাজনীতি, জেন্ডার ইনসাল্ট তেমন কয়েকটি ধরণ।
২০১৩ সালের আরেক একাডেমিক পেপারেও ল্যাট্রিনালিয়ার প্রায় একই রকম শ্রেণীবিন্যাস দেখা যায়। ‘On the Shit house wall: The Communicative Value of Latrinalia’. Eastern Kentucky বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন টয়লেট থেকে গবেষক থমাস লাভলি মোট ৯৬৫টা গ্রাফিতি সংগ্রহ করেন। থমাস ল্যাট্রিনালিয়ার শ্রেণিবিন্যাসে ‘Blacked out’ নামের আওতায় টয়লেটের কারও লেখা অন্য কারও দ্বারা মুছে দেওয়াকে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন যে ধরণটা When walls speak এ অনুপস্থিত।
ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল, মার্কেট, ক্লিনিক, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাট্রিনালিয়া ভয়ানক সব গালি, মেয়েদের দেহ নিয়ে জঘন্য সব মন্তব্য কিংবা যৌনতা-নির্ভর লেখালেখিতে ভরপুর। কবিতা কিংবা গান এই শহরের পাবলিক টয়লেটের ওয়াল খুবই কম দখল করে থাকে।
ঢাকার পাবলিক টয়লেটের দেয়াল, জানালা, দরজায় সেঁটে থাকা লেখাগুলোকে মোটামুটি ১০ ভাগে ভাগ করা যায়-
১. মেয়েদের দেহ কেন্দ্রিক মন্তব্য ২. গালি ৩. রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের মন্তব্য ৪. কারও নাম দিয়ে সঙ্গে মোবাইল নাম্বার ৫. যৌনতা কেন্দ্রিক ইচ্ছা-অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ ৬. বাজে মন্তব্য না লেখার অনুরোধ কিংবা বাজে মন্তব্য লেখকদের প্রতি প্রদত্ত গালি ৭. কবিতা কিংবা গান ৮. এডাল্ট জোকস ৯. ধাঁধা কিংবা সরস উক্তি ১০. ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার আহবান কিংবা ভয় উদ্রেকের চেষ্টা।
লেখালেখির বাইরে আছে নারী-পুরুষের যৌনাঙ্গ কিংবা ফুল-পাখি-মানুষ আঁকার চেষ্টা। এই শ্রেণিবিন্যাস শুধুমাত্র পুরুষের জন্য বরাদ্দ পাবলিক টয়লেটের তথ্যর উপর নির্ভর করে তৈরি করা। নারীদের জন্য বরাদ্দ পাবলিক টয়লেটের ল্যাট্রিনালিয়ার স্বরূপ জানা গেলে শ্রেণিবিন্যাস হয়তো ভিন্নভাবে দাঁড়াত। অবশ্য নারীদের টয়লেটে ল্যাট্রিনালিয়া আদতে কতোটা নারীদের সৃষ্টি সেটা নির্ধারণ করা বেশ কঠিন কাজ।
মানুষ টয়লেটে কেনো লেখে, সমাজের কোন ধরণের মানুষেরা এসব লেখে, নারী-পুরুষে টয়লেট গ্রাফিতিতে কী কী পার্থক্য দেখা দেয় এ নিয়ে পাশ্চাত্যে প্রচুর না হলেও বেশ অনেক গবেষণা হয়েছে। পাশ্চাত্যের গবেষণায় এসেছে- টয়লেটে নারীদের তুলনায় পুরুষদের বেশি লেখার প্রবণতা কিংবা নারীদের অধিক ছবি আঁকার ঝোঁক, কিংবা পুরুষ টয়লেট যেখানে ভরে ওঠে স্তন কিংবা শিশ্নের ছবিতে সেখানে নারীদের টয়লেটে দেখতে পাওয়া যায় হার্টের ছবি কিংবা রোমান্টিক বাক্যর আধিক্য।
ঢাকার একটা ক্লিনিকের টয়লেটে দেখতে-পাওয়া কিছু লেখার উল্লেখ করা যেতে পারে-
‘বাজে কথা লিখার দরকার নাই
আচরণ সভ্যতার পরিচয় বহন করে’
‘খারাপ কথা লেখবে না পিলিচ পিলিচ’
‘Please bad behave stopped’
ক্লিনিক থেকে সংগ্রহ করা গালি, আক্রমণাত্মক ও যৌনতাকেন্দ্রিক লেখা উল্লেখ করা যাচ্ছে না পাঠক-রুচির কথা বিবেচন করে।
উক্ত ক্লিনিকের লেখার বেশিরভাগ কলমে লেখা- কালো, নীল কালির সঙ্গে লাল ও গোলাপি রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। নাম সহকারে অনেক মোবাইল নাম্বারের উল্লেখ আছে, বেশিরভাগ নাম নারীর; একটা মোবাইল নাম্বারের নিচে দেখতে পাওয়া যায় লেখা আছে- কোটিপতির মেয়ে।
লেখাগুলো দেখে গড়পড়তায় হয়তো কিছু কথা বলে দিতে পারা যায়, যেমন যারা এসব লেখে তাদের মানসিক বিকৃতি আছে কিংবা এসব লেখা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ অথবা যৌনতা বঞ্চিত মানুষদের অভিপ্রায়ের প্রকাশ বা কারো নাম সঙ্গে মোবাইল নাম্বার লিখে প্রেমে ব্যর্থ প্রেমিক অথবা প্রেমিকার বা ভিন্ন কোন কারণে কারও ব্যক্তিগত আক্রোশ প্রকাশ। এ ধরণের দাবিতে টয়লেট গ্রাফিতির গভীর সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের অভাব থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
লেখার শেষে অন্তর্জালে পাওয়া একটা টয়লেট গ্রাফিতির উল্লেখ করা যেতে পারে-
‘No matter what you are going through, you are strong’
সারাবাংলা/পিএম