নয়ন জুড়ানো নৌকা
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৪:০৬
।। এসএম মুন্না ।।
‘নৌকা’-নদীমাতৃক বাংলাদেশের জলপথের প্রধান বাহন। দেশের প্রতিচ্ছবিও বটে এই নৌকা। বাউল সাধক ও তত্ত্বজ্ঞানীদের তত্ত্ব ও মারফতি কথাবার্তাতেও আছে নৌকার কথা। ফকির লালন সাঁই লিখেছেন ‘পাড়ে কে যাবি, নবীর নৌকাতে আয়, রূপ-কাঠির নৌকাখানি নেই ডুবার ভয়’। কল্পলোকেও সোনার নাও, পবনের বৈঠার কথা আছে। মরমী গানের সুরে ঝঙ্কার তুলেছেন সাধক-কবিরা। বলেছেন ‘আমি বাইয়া যাইয়া, কোন ঘাটে লাগাব সোনার নাও’। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে এখনকার শিল্পী-সাহিত্যিক ও কবিরাও নদী ও নৌকা নিয়ে অসংখ্য রচনা, ছবি, চিত্রকর্ম এবং গান লিখে যাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নদীবিধৌত এই বাংলার পদ্মা-যমুনা-ধলেশ্বরী আর নাগর নদের বাঁকে বাঁকে ঘুরেছেন। সেই নদীমালা ও নৌকা নিয়ে এঁকেছেন অনেক চিত্রগাথা। ‘সোনার তরী কাব্য’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ-‘আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে/ হে সুন্দরী?/ বলো, কোন্ পার ভিড়িবে তোমার/ সোনার তরী।’
দীর্ঘকাল ধরে নৌকা এদেশের সমাজ-সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত হয়ে আছে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও পুরনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতীক ‘নৌকা’। নৌকার মাঝি পাল তুলে যেতে যেতে বাংলার নিজস্ব সুরের গান, বিশেষ করে পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, জারি-সারি, মুরশিদী কণ্ঠে ধারণ করে। বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে নৌকা সামাজিক-অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নৌকা কবে, কখন, কার হাতে প্রথম তৈরি হয়ে পানিতে ভেসেছে, তা সঠিক করে বলা যায় না। তবে এদেশে যখন থেকে নদীর প্রবাহ শুরু হয়েছে, তখন থেকেই নৌকার প্রচলন হয়েছে। এই ব-দ্বীপাঞ্চলে নৌকা নদী পথের একটি অপরিহার্য বাহন বা আশ্রয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকেই।
সুদূর অতীতে এই দেশে প্রায় অর্ধশত রকমের নৌকার প্রচলন ছিল। এখন আর নেই। হাতে গোনা মাত্র কয়েক ধরণের নৌকার চল রয়েছে। আধুনিক সভ্যতা ও নতুন নতুন প্রযুক্তির এই সময়ে যাতায়াত ও যানবাহনের ক্ষেত্রে যে উন্নতি হয়েছে, তা এক সময় কল্পনারও বাইরে ছিল। ছিল না বিমান ব্যবস্থা, রেল ব্যবস্থা, বাস-ট্রাক-প্রাইভেট কারসহ নানান ধরনের বাহন। তখন জলে নৌকা এবং স্থলে গরু বা মহিষের গাড়ি, পালকি, ঘোড়ার গাড়ি আর পায়ে হেঁটে যাতায়াত করত প্রাচীন ও মধ্য যুগের বাংলাদেশের মানুষ। ফলে জলযান নৌকার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
গুরুত্ব অনুধাবন করেই জাতীয় জাদুঘরের জাতিতত্ত্ব ও অলঙ্করণ শিল্পকলা বিভাগের অধীনে নৌকা ও নৌকার মডেল সংগ্রহ করা হয়েছে। ১৭৯ রকমের নৌকার মডেল সংরক্ষিত আছে জাতীয় জাদুঘরে। প্রজন্মের পর প্রজন্মের কথা চিন্তা করে জাতীয় জাদুঘরের ১২ নম্বর গ্যালারিটি সাজানো হয়েছে ৬০টি রকমের নৌকার মডেল দিয়ে। এর মধ্যে ৭১ ফুট দৈর্ঘের বাইচ নৌকা প্রদর্শন করা হচ্ছে। বিশ শতকের শেষভাগে নির্মিত এই নৌকাটি সংগ্রহ করা হয়েছে মানিকগঞ্জ থেকে। এ রকম আরও ১১৯টি মডেল সংরক্ষিত রয়েছে জাদুঘরের বিভাগীয় স্টোরে। আছে ডিঙ্গি নৌকাও। জাতীয় জাদুঘরের জনশিক্ষা বিভাগের কীপার ড. শিহাব শাহরিয়ার জানালেন ‘নৌকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরার প্রয়াস হিসেবে ১৯৮৩ সালে এই গ্যালারি স্থাপন করা হয়’।
গ্যালারিতে দেখা মিলছে-পানসী, সাম্পান, রপ্তদী, লক্ষ্মীবিলাস, বজরা, বাছারি, সুড়ঙ্গা, এক মালাইয়া, বালাসী নৌকা, পঞ্চবটি, জং, দোসাল্লাই, পাকালিয়া নৌকা, পাতাং, ঘাসী, গয়না, সথুরা গড়, পাতিলা, পলারী, বিলাসী নৌকা, বেলাল, করপাইয়া বাচারি, বিল্পী, লাকালিয়া, তালের নাও কোন্দা, লম্ব-পদি, নায়রি, ফেটি, বালার, বানকি, গোঘী, জাইলা ডিঙি, পিনাশ, রপতানি বা পালটাই, কেরায়া ইত্যাদি নৌকার মডেল।
শুধু উপর্যুক্ত নৌকাই নয় রয়েছে আরও অনেক রকমের নৌকা। নামগুলো যেমন ভিন্ন তেমনি আবার নৌকাগুলো একই অঞ্চলের নয়, বিভিন্ন অঞ্চলের। পাবনা অঞ্চলের নৌকার সাথে চট্টগ্রাম অঞ্চলের নৌকার যেমন মিল নেই, তেমনি সিলেট অঞ্চলের নৌকার সাথে ফরিদপুর বা শেরপুরের নৌকার রকমফের রয়েছে।
নৌকা তৈরির প্রধান উপাদান কাঠ। সূচনাতে সাধারন মানুষ মোটা কাঠের আস্ত গুঁড়ি খোদাই করে ভিতরে গোলাকৃতি ফাঁকা স্থান সৃষ্টি করে নৌকা বানাত। পরবর্তীতে বেত, বাঁশ, চামড়া, এবং কাঠের আঁটি বেঁধে নৌকা তৈরি করা হতো।
এখন নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হয় ফেরোসিমেন্ট ও ফাইবার গ্লাসের মতো আধুনিক উপকরণ। তবে হাজার বছর ধরে দেশে ঐতিহ্যগতভাবে কাঠই নৌকা তৈরির প্রধান উপকরণ হিসেবে বহাল আছে। জারুল, শাল, সুন্দরী এবং বার্মা সেগুন প্রজাতির কাঠ এই কাজে ব্যবহৃত হয়।
ছোট বা বড় সব ধরনের নৌকারই বিভিন্ন অংশের আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। তবে এই নামগুলোরও আবার অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন শব্দে উচ্চারিত হয়। যেমন- দাঁড়, বৈঠা, লগি, পাটাতন, গলুই, মাস্তুল, চারট, ছই, পাল বা বাদাম, গুড়া, হাঁসাবাতা, সোয়ারি-বাতা, কোলঝাঁপ, মালুমকাঠ।
পাশাপাশি নৌকার চালকদের নামও এখানে উল্লেখ করা যায়। মূলত মাঝি নামেই এরা পরিচিত। তবে আঞ্চলিকভাবে নাইয়্যা, নাওয়া ইত্যাদিও বলা হয়। মধ্যযুগের বাংলা কবিতায় বাণিজ্যিক নৌকার চালকদের কয়েকটি উপনামে ডাকা হতো যেমন-ভাগী, সাজী, গলইয়া, ডাকুয়া, মাঝী, দাঁড়ী প্রভৃতি।
পেশাজীবী জেলে ও বেদে সম্প্রদায় বাস করে নদী ও নদীসংলগ্ন তীরবর্তী অঞ্চলে। আরও একটি পেশাজীবী শ্রেণী রয়েছেন তারা হলো- খেয়াঘাটের মাঝি। এই তিন পেশাজীবী শ্রেণীর মানুষদের নৌকা হলো নিত্যসঙ্গী ও প্রয়োজনীয় উপাদান। এদের জীবনের অংশের সাথে জড়িয়ে আছে নৌকা। জেলেরা নৌকায় চড়ে কেউ কেউ সারাদিন বা কেউ কেউ সারারাত মাছ ধরে তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে।
খেয়াঘাটের মাঝিরাও তাই। নৌকা দিয়ে যাত্রী পারাপার করে যা তাদের আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চলে। এই নদী এই মাঝিদের জীবনের সুখ-দুঃখ, গাথা-কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক সাহিত্য। প্রখ্যাত কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, আশরাফ-উজ-জামান খানের ‘খেয়াঘাটের মাঝি’ এর অন্যতম।
বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের আনাচে-কানাচে বিভিন্ন রকমের ছোট-বড় নৌকা খেয়া পারাপার, মালামাল পরিবহন, মাছধরাসহ নানান কাজে ব্যবহৃত হয়।
বাংলার লোক-সাহিত্যে ‘চাঁদ-সওদাগর’ তার ‘সপ্তডিঙ্গা মধুকর’ এই আবহমান বাংলারই এক অনন্য বাহন হিসেবে স্থান লাভ করে আছে। এই নৌকা বা ‘সপ্তডিঙ্গা মধুকর’ কিংবা ‘ময়ুরপঙ্খী নাও’ কখনো পালের হাওয়ায় আবার কখনো ষোল দাঁড়ের বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ টানে তরতর বেগেই ছুটে চলেছে মধুমালার দেশে।
লোক গানের এক উর্বর স্থান হলো বাংলাদেশ। তাই নদী ও নৌকা-কেন্দ্রিক অসংখ্য লোকগানের সৃষ্টি হয়েছে এখানে। এসব গান জীবন-ঘনিষ্ঠ। আবার কখনও দেখা যায়, জীবন জিজ্ঞাসায় হতাশার আর্তিও ফুটে উঠতে যেমন- ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে/ আমি আর বাইতে পারলাম না’ কিংবা ‘মাঝি বাইয়া যাও রে অকুল দরিয়ার মাঝে আমার ভাঙা নাও রে মাঝি…’।
আরও আছে ‘কলকল ছলছল নদী করে টলটল ঢেউ করে… তুমি নাও বাইও না মাঝি ভীষম দইরাতে’। বাংলা অঞ্চলের চিত্রশিল্পীদের তুলির আঁচড়েও অসংখ্য নৌকা ও নদীর চিত্র ফুটে উঠেছে।
ছবি: লেখক
সারাবাংলা/পিএম