Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জয়তু নাদিয়া ও মুকওয়েজ, ধর্ষণ আর না হোক যুদ্ধাস্ত্র


৮ অক্টোবর ২০১৮ ১৫:২৮

এবছর শান্তিতে নোবেল জেতেন নাদিয়া মুরাদ ও ডেনিস মুকওয়েজ

রাজনীন ফারজানা ।। 

উত্তরাঞ্চলীয় ইরাকের সিনজার অঞ্চলটি ইয়াজিদি গোত্রের মানুষের বাস। এখানকার এক গ্রাম কোচো। ২০১৪ সালে পুরো অঞ্চলটি লণ্ডভণ্ড করে দেয় ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা। শত শত ইয়াজিদিকে হত্যা করে ও গণকবর দিয়ে অসংখ্য ইয়াজিদি তরুণীকে অপরহরণ করে নিয়ে যায়। তার মধ্যে ছিলেন কোচো গ্রামের ২১ বছরের ইয়াজিদি তরুণী নাদিয়া মুরাদ। পরের তিন মাসে অগণিতবার গণধর্ষণের শিকার হতে হয় তাকে। পরে একটা সুন্নি মুসলমান পরিবারের সহয়তায় সেখান থেকে পালাতে সক্ষম তিনি। ওই সময়ের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বইয়ে নাদিয়া বন্দিদশার সময়কে তুলনা করেন ‘ধীরে ধীরে এক কষ্টদায়ক মৃত্যু’র সঙ্গে। শুধু শরীরী মৃত্যুই নয়, একে তিনি ‘আত্মার মৃত্যু’ বলেও অভিহিত করেছেন।

বিজ্ঞাপন

নাদিয়ার লেখনীতে আইএস-এর বর্বরতার যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা পড়তে পড়তে শিউরে ওঠে বিশ্ব মানবতা। তবে নাদিয়ার জন্য এর পরের কাহিনী কেবলই অর্জনের। ২০১৬ সালে তাকে মানবপাচারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষদের জন্য জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত করা হয়। সেই থেকে সারাদুনিয়া ঘুরছেন তিনি, আইএস জঙ্গিদের হাতে সংগঠিত যুদ্ধাপরাধ আর তাদের হাতে বন্দি ইয়াজিদিদের মুক্তির বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছেন। যেখানেই সুযোগ পাচ্ছেন, আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে কথা বলছেন, বক্তব্য রাখছেন।

বিশ্বজুড়েই প্রতিনিয়ত যুদ্ধ আর অমানবিকতার শিকার হয়ে চলেছেন নারীরা। তবে তাদের সঙ্গে নাদিয়া মুরাদের পার্থক্য হলো— নির্যাতনের অত্যাচারিত হয়েও থেমে যাননি তিনি। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে সমাজ থেকে মুখ লুকিয়ে বাঁচার জীবন বেছে নেননি বলেই তিনি ব্যতিক্রমী, অনন্যা। ইরাকের সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এই নাদিয়া মুরাদ সকল অত্যাচারিত, নিপীড়িত মেয়েদের অধিকারের জন্য লড়েছেন। ধর্ষণকে যেভাবে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত আওয়াজ তুলে যাচ্ছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

গত বছর দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাদিয়া বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে যা ঘটেছিল, তাতে আমার কোনো হাত ছিল না। যে নির্যাতন সেখানে হচ্ছে, তা নিয়ে কাউকে না কাউকে বলতেই হতো। সেই বলার কাজটা আমিই করছি। কিন্তু কাজটা মোটেই সহজ নয়।’

নাদিয়ার এই সাহসিকতা বিশ্বকে যে বার্তা দেয় তা হচ্ছে— হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। আর নারীর শরীর যেন কারও যুদ্ধাস্ত্র না হয়ে ওঠে, কাজ করে যেতে হবে সেজন্য।

এই অবদানের জন্যই দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী হিসেবে নাদিয়া মুরাদকে সম্মানিত করল নোবেল পিস কমিটি। যৌথভাবে ২০১৮ সালের নোবেল শান্তি পুরষ্কার পাওয়ার খবর শুনে কেঁদে ফেলেন ২৫ বছরের নাদিয়া। এর আগে ১৭ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী হয়েছিলেন পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই।

তবে এরও আগে ২০১৬ সালে যুগ্মভাবে ইইউ’র মর্যাদাকর সাখারভ হিউম্যান রাইটস পুরস্কার জেতেন হন নাদিয়া মুরাদ। সে বছর তিনি কাউন্সিল অব ইউরোপের ভ্যাকলাভ হ্যাভেল হিউম্যান রাইটস পুরস্কারেও ভূষিত হন।

ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোকে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা একসময় ডাকতেন ‘ধর্ষণের রাজধানী’ নামে। কঙ্গো, রুয়ান্ডা ও উগান্ডার আক্রমণকারীরা কঙ্গোর পূর্ব প্রান্তে বছরের পর বছর ধরে ধর্ষণ ও লুটতরাজ চালিয়েছে। হাজার হাজার নারীর ওপর অমানবিক অত্যাচার চালিয়েছে তারা।

কঙ্গোর এক যাজকের সন্তান মুকওয়েজ ফ্রান্স থেকে ধাত্রীবিদ্যায় প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরেন। ১৯৯৯ সালে গড়ে তোলেন প্যানজি হসপিটাল নামে একটি মাতৃসদন। এই ক্লিনিকে প্রথম যে রোগীর চিকিৎসা করেন, তিনি ছিলেন ধর্ষণের শিকার এক নারী। এরপর তার ক্লিনিকে যেন নামে ধর্ষণের শিকার নারীদের ঢল। মুকওয়েজ বুঝতে পারেন, যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এসব নারীদের। এরপর দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে প্যানজি হসাপাতালে ৫০ হাজারেরও বেশি ধর্ষণের শিকার নারীকে চিকিৎসা দিয়েছেন। তিনি নিজে সরাসরি কাজ করেছেন ১০ হাজারেরও বেশি নারীর সঙ্গে, বাঁচিয়ে তুলেছেন তাদের। কখনও কখনও দিনে ১৮ ঘণ্টারও বেশি কাজ করতে হয়েছে তাকে।

২০১৩ সালে মুকওয়েজ ও তার দল কয়েক ডজন কিশোরী মেয়ের চিকিৎসা করেন। তারা সবাই ছিল প্রাদেশিক সংসদের একজন সদস্যের সৈন্যদলের হাতে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার। ওই সংসদ সদস্য বিশ্বাস করতেন, শিশুদের ধর্ষণ করলে তারা শত্রুদের থেকে নিরাপদে থাকবে। ২০১২ সাল থেকেই হত্যার হুমকি পেয়ে আসা মুকওয়েজকে এই শিশুদের জীবন বাঁচানোর কারণে এবার হুমকি পান সপরিবারে অপহরণের। শুধু হুমকি নয়, রীতিমতো হামলা চালানো হয় তার ওপর। কোনোমতে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। এরপর আড়াই মাস ফ্রান্সে থাকলেও ফের কঙ্গোতে ফিরে ধর্ষণের শিকার নারীদের নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন মুকওয়েজ।

চিকিৎসার মাধ্যমে শুধু ধর্ষণের শিকার নারীদের জীবন বাঁচানোই নয়, মুকওয়েজ বরাবরই মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কঙ্গো সরকারের কড়া সমালোচনা করেছেন। প্রায় এক দশক ধরেই নোবেল শান্তি পুরষ্কারের তালিকায় মুকয়েজের নাম আসে। অবশেষে ৬৩ বছরের মুকওয়েজকে তার কাজের জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেওয়া হলো ২০১৮ সালে এসে, যেন নোবেল পিসি কমিটি নিজেরাই নিজেদের সম্মানটা বাড়ালো। আর নোবেল শান্তি পুরষ্কার জয়ের খবরটি যখন পৌঁছায় মুকওয়েজের কাছে, তখনও তিনি অপারেশন থিয়েটারে ধর্ষণের শিকার কোনো এক নারীরই চিকিৎসা করছিলেন।

১৯০১ সালে প্রথমবারের মতো নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়। সেবার শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন রেডক্রসের প্রতিষ্ঠাতা সুইজারল্যান্ডের বাসিন্দা হেনরি ডুনান্ট। রেডক্রস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য, মর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য তিনি এই পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। প্রথমবারের মতো নোবেল পুরষ্কার দেওয়ার ঠিক ১১৭ বছর পর এ বছর নিপীড়িত মানুষের জন্য কাজ করে নোবেল শান্তি পুরষ্কার অর্জন করেন কঙ্গোর চিকিৎসক ডেনিস মুকওয়েজ আর ইরাকের মানবাধিকাকর্মী নাদিয়া মুরাদ। যুদ্ধের সময় যৌন নিপীড়নকে যেভাবে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে এই সম্মান অর্জন করেন তারা। ইসলামিক স্টেট বা আইএসের যুদ্ধবন্দি হিসেবে দীর্ঘদিন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন নাদিয়া মুরাদ। আর যুদ্ধের সময় ধর্ষনের শিকার নারীদের চিকিৎসা করেন মুকওয়েজ।

পুরষ্কার ঘোষণার দিন নোবেল কমিটি থেকে বলা হয়, যুদ্ধের সময় নারীদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা গেলে ও তাদের নিরাপত্তা দেওয়া গেলেই কেবল বিশ্বে আরও বেশি শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

নরওয়ের নোবেল কমিটির সভাপতি বেরিট রেইস-অ্যান্ডারসন এক বিবৃতিতে বলেন, গোটা বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠীই নারী। কিন্তু নানা জাতিগোষ্ঠীতে নারীদের যেভাবে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি আমরা। এ বছরের নোবেল শান্তি পুরষ্কারের মাধ্যমে আমরা বিশ্বের সবার কাছে এই বার্তাটাই পৌঁছে দিতে চাইছি।

‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তি রক্ষার পূর্বশর্ত হলো নারীদের সুরক্ষা দেওয়া ও যুদ্ধাপরাধীদের কৈফিয়ত দিতে বাধ্য করা’,— যোগ করেন বেরিট।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ও দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে 

সারাবাংলা/আরএফ/এমএম/আরএফ 

ইয়াজিদি ইরাক কঙ্গো জাতিসঙ্ঘ ডেনিস মুকওয়েজ ধর্ষণ ধর্ষণের রাজধানী নাদিয়া মুরাদ নোবেল পুরষ্কার নোবেল শান্তি পুরষ্কার ২০১৮ পাকিস্তান প্যানজি হাসপাতাল ফ্রান্স মালালা ইউসুফজাই যুদ্ধাস্ত্র রেড ক্রস সাখারভ হিউম্যান রাইটস পুরষ্কার সিনজার অঞ্চল হিউম্যান রাইটস হেনরি ডুনান্ট

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর