এ গল্পের নাম জানিনা
২১ অক্টোবর ২০১৮ ১১:০৫
দুপুরের দিকটা লুকানোর জন্য ভালো। যদিও সে দুপুর বলতে কি বোঝায়, ঠিকঠাক জানেনা। লুকিয়ে যাওয়া কাকে বলে, সে জানেনা। সে জানে দুপুর এমন এক সময়, যখন মা তাকে ভাতমাখা মুখে তুলে খাইয়ে দিয়ে, নিজের খাওয়া শেষ করে, হাড়ি পাতিল ধুয়ে, গোসল ভেজা চুল বালিশে বিছিয়ে একটু সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে। পালিয়ে যাওয়া কাকে বলে সে না জানলেও, এটা সে জানে যে, এই সময় সে উঠোনের ওপরের ধান ক্ষেতের ধারে বসে গাছের নানা রঙের পাতা কুড়িয়ে, সাজিয়ে মাটির উপর নকশা সাজাতে পারে। শুধু মা যখন ঘুম থেকে উঠে তার নাম ধরে ডাকবে, তাকে এক দৌড়ে উঠোন পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে।
মৌটুসী যে তার নাম সে তা জানে। সে জানেনা যে তার জন্মের আগখান দিয়ে, একজোড়া মৌটুসী পাখির বাসা ছিল তাদের উঠোনের ধারের জংলা বাগানের কোণে। সেই জোড়া পাখির রংচঙা রূপে আর তাদের বাসা বাধার গানের আনন্দময় সুরে মুগ্ধ হয়ে, বাপ মা তার নাম রেখেছিলো মৌটুসী। সে এখনো জানেনা, কেমন করে তার নাম মৌটুসী হলো। জানার বয়স হলে নিশ্চয়ই জানবে। সে যে প্রতিদিন নতুন কিছু শেখে, সেটা ঠিক অনুধাবন করতে না পারলেও, শেখার আনন্দকে সে অনুভব করতে পারে।
সুরের সাথে তার বেশ সখ্য গড়ে উঠছে। ইদানিং গুনগুন করে সুর ভাজে সে, যখন পাতা দিয়ে দুপুরের গরম মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে নকশা সাজায়, তখন। বাবা যখন সব কাজ শেষে রাতে গলা ছেড়ে গান গায় উঠোনে বসে, সে গান শুনতে শুনতে কখন যেন প্রতিরাতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। মনে আর কণ্ঠে সুর ধরেছে তার, কখন সে জানেনা। সে শুধু সুর জানে। আর জানে দু তিন টুকরো কথা – সখিরে আনা আনা, সোনা।
এই টুকরো শব্দ মিলিয়ে সে সুর ভাঁজে যখন সে দুপুরে গরম রোদে পা ছড়িয়ে বসে পাতার নকশা সাজায়, তখন। সুরের সাথে সাথে শুধু কানদুটোকে সচেতন রাখতে হয়। যখন মা নাম ধরে ডাকে। ডাকে সারা না দিলে মা ঠিক চলে আসে এখানে। আর মা যখন দেখে সে উঠোনের ওপারে ক্ষেতের ধরে এসে একা বসে আছে, তাহলে পিঠে দুয়েক ঘা পেতে হয়। মায়ের যা রাগ!
সব আনন্দের হিসাব নিকেশ আছে। সেই হিসাব নিকেশ কখনো খুব গোলমেলে হয়। এই যেমন তার এই পাতা খেলার পরে যদি মায়ের হাতে পরে ধরা, দুমদাম পিটুনি। এই আনন্দের পর কেনো যে ঝামেলা আসে – এই হিসেবে নিকেশের প্রক্রিয়াটা সে না জানলেও এটা সে জানে, যে পাতা সাজানোর খেলায় খুব আনন্দ হয়। আর মায়ের ডাকে ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরে গেলে, কোনো ভয় নেই। সবটুকুই আনন্দ। সব ঠিকঠাক। মা তার উকুন বেছে, তেল দিয়ে চুলে বেণী করে দেয়, আর রাজা-রানীর গল্প শোনায়। আর ঠিক তারপরপরই সন্ধ্যা নামে, প্রতিদিন।
তবে সে জানেনা যে প্রতিদিন এক রকম হয়না। এই যে আজ সে মাত্র পাতা সাজিয়ে বসেছে, কেন যে মা এতো জোরে পিঠে এসে ধাক্কা দিলো? ধাক্কা দিলো তো দিলো, সে একদম গড়িয়ে ধানের ক্ষেতে। ভয়ে বুঁজে যাওয়া চোখজোড়া খুলে যখন তাকালো, মাকে তো দেখতে পেলোনা। দেখবার সময়ও যে সে পেলোনা। তাকে যদি জাপ্টে ধরে ঝোপের মধ্যে নিয়ে ছুড়ে ফেলা না হতো, তার মুখ যদি কমলা রঙের গামছায় বাধা না থাকতো, জীবনের অজানা অদ্ভুত তীব্র বেদনার ছটফটানি সময় যদি এটা না হতো, তবে সে চিৎকার করে মা কে ডাকতো। রক্তের তীব্র লাল রঙের দিকে অবাক দৃষ্টি, সে ঠিক জানেনা এই রঙের নাম যে লাল। অথবা সে ভুলে গিয়েছিলো। সে সময়ে শুধু মাকেই খুঁজছিলো। তার শুধু মায়ের কথাই মনে হয়েছিল।
পরদিন দৈনিক পত্রিকার অনেক খবরের ভিড়ে কারো কারো দৃষ্টি আটকেছে, হয়তো – “পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা।”
আর তখন সে শুধু আসেপাশে মাকে খুঁজছিলো। আর শেষবারের মতন চোখ মেলবার সময় তার ভীষণ অভিমান হয়েছিল, কেউ তাকে কেনো বলেনি, রাজা রানীর গল্পের সেই জঙ্গলের হিংস্র পশুগুলো ঠিক মানুষের মতো দেখতে?
কিযী তাহনিন: গল্পকার, উন্নয়ন ও সেবাকর্মী। ঢাকায় একটি জাতিসংঘ সংস্থার বাংলাদেশ কার্যালয়ে কর্মরত
[প্রিয় পাঠক, কিযী’র জানালা থেকে সারাবাংলা.নেট এর একটি নতুন আয়োজন। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন উপরের গল্পটি নিছক কোনও গল্প নয়, এটিই সমাজের এক ভয়ঙ্কর চিত্র। কিযী তাহনিন তার গল্পগুলোয় এমন সমাজের সমস্যা, সঙ্কট, ভয়াবহতা তুলে ধরবেন গল্প বলে বলে। আশা করি এর মধ্য দিয়ে হয়তো সচেতন হয়ে উঠবে সমাজ, পাল্টাবে মানুষগুলোর মন-মানসিকতা।]
সারাবাংলা/এমএম