ভাষাও যখন নারীকে অবমাননা করে
২৮ অক্টোবর ২০১৮ ১০:২৮
তিথি চক্রবর্তী।।
সমাজে পুরুষতন্ত্রের যে আধিপত্য, ভাষা সেই আধিপত্যের জমিনকে সুদৃঢ় করেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অন্য অনেককিছুর মতো ভাষাও নারীর উপর আধিপত্য সৃষ্টি করে। ভাষা হয়ে দাঁড়ায় পুরুষতন্ত্রের দাস। ভাষাও নারীকে করে অবমাননা।
হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা ও তার নিরিখে নির্মিত ভাষা নারীকে নানাভাবে অবদমন করছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে টিকিয়ে রাখতে ভাষা একটি মুখ্য শক্তি হয়ে উঠেছে।
ভাষার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, মানুষের মুখের ভাষাটাই সংযোজন বিয়োজনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে বই পুস্তকে সংরক্ষণ করেছেন ভাষা বিশ্লেষক ও বিজ্ঞানীরা। বইয়ের ভাষা নানা সময়ে সংশোধন বা পরিমার্জন করা হয়েছে। তাছাড়া ভাষা নিয়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন। কিন্তু ভাষায় জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়টি বেশিরভাগ সময়ই থেকেছে উপেক্ষিত। ভাষাও পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে আর নারীকে করেছে হেয়। পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার অসংবেদনশীল অনেক শব্দ, বাগধারা কিংবা প্রবাদ প্রবচন সংযোজন করা হয়েছে। যেমন ‘ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন, যদিও বা পৃথক হয় তবে নারীর কারণ’ কিংবা ‘ঝিঁকে মেরে বৌকে শেখানো’। আমরা ছোটবেলা থেকেই এই প্রবাদগুলোর সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত।
ফলে ছোটবেলাতেই একজন শিশুর মনে ছেলে ও মেয়ে সম্পর্কিত একটি ধারণা তৈরি হয়ে যায়। ছেলে হবে শ্রেষ্ঠ আর মেয়ে হবে পতি বা পুরুষের দাস। ছেলে শিশুর মননে গেঁথে যায়, সে মেয়েদের অবদমিত করবে। আর মেয়ে শিশু ভাবে তাকে এই সমাজের সমস্ত অসঙ্গতি মেনে নিতে হবে। পুরুষ যেভাবে তাকে দেখতে চাইবে সেভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। এই ধরনের চিন্তাগুলো ছোটবেলা থেকেই ভাষার মাধ্যমে শিশুর চিন্তায় ও মননে গেঁথে যায়। তাই বড় হয়েও ছেলেরা মেয়েদের সম্মান করতে শেখে না।
এখন সমাজে যেসব গালিগালাজ প্রচলিত, সবগুলো নারীকে উদ্দেশ্য করেই। জেন্ডার অসংবেদনশীল এসব প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা, শ্লোক ও শব্দগুলো যদি শুধুমাত্র বইপুস্তকে সংরক্ষণ করা থাকতো এবং ভাষা নিয়ে যারা কাজ করছেন বা যাদের এ সম্পর্কে জানার আগ্রহ আছে তারাই কেবল এই সংরক্ষিত বইগুলো পড়তো তাহলে সমস্যা সৃষ্টি হতো না। তাতে একাডেমিক পড়াশুনা করতে গিয়ে অন্তত জেন্ডার অসংবেদনশীল এই ভাষাগুলোর সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটতো না এবং সমাজে অবলীলায় এসব শব্দের ব্যবহার কমে যেত।
সম্প্রতি একটি গবেষণায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ২৫ টি বইয়ের মোট ৩৪৬৪ পৃষ্ঠার আধেয় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, পাঠ্যপুস্তকের ভাষায় জেন্ডার সংবেদনশীলতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যেমন পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন জায়গায় ‘শিক্ষার্থী’ না লিখে ‘ছাত্রছাত্রী’ লেখা হয়েছে। আবার বিভিন্ন বইয়ে ‘কৃষক’ শব্দকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যার মাধ্যমে শিশুরা ধরে নেবে কেবল ছেলেরাই কৃষিকাজ করে। কিন্তু গ্রামের মেয়েদের একটি বিরাট অংশ কৃষিকাজের সাথে যুক্ত এই বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়নি।
এই গবেষণার ফলাফলে আরও দেখা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ের অনেক বইয়ে মেয়েদের নামের আগে ‘মিসেস’ ব্যবহার করা হয়েছে, যার মাধ্যমে নারীর স্বতন্ত্রতা হারিয়ে গেছে। যেমন তাকে বলা হচ্ছে মিসেস মাসুদ। অর্থ্যাৎ স্বামীর পরিচয়ে নারী পরিচিত হবে। আবার পাঠ্যপুস্তকের অনেক জায়গায় মহিলা শব্দটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জেন্ডার নিরপেক্ষতা বজায় থাকেনি। মহিলা অর্থ ‘যে মহলে থাকে’। এই ধরনের শব্দগুলো পাঠ্যপুস্তকেই শিখছে শিশুরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুই পরিচালিত হয় পুরুষতন্ত্র দিয়ে। কিছু কিছু শব্দ আছে, তা শুধুই নারীর জন্য। যেমন অসতী, পতিতা এগুলোর কোন পুরুষবাচক শব্দ নেই। আবার জেন্ডারের দিক থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ইংরেজি ব্যাকরণের Person বাংলা ব্যাকরণে ‘ব্যক্তি’ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বাংলা ব্যাকরণে Person এর বাংলা হলো ‘পুরুষ’- উত্তমপুরুষ, মধ্যমপুরুষ ও নামপুরুষ।
আবার কিছু কিছু শব্দ অত্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক। যেমন ‘বাপ কা বেটা’- এই শব্দের মধ্য দিয়ে পুরো সুনাম বা খ্যাতি চলে যায় বাবার কাছে। মানে ছেলে ভাল কিছু করলে তখন সে হয় বাবার ছেলে। আর খারাপ করলে হয় মায়ের মতো। যেমন- চোরের মায়ের বড় গলা।’
শিল্প, সাহিত্যের ক্ষেত্রে
ভাষা সমাজেরই একটি অংশ। সমাজ যখন জেন্ডারকে গুরুত্ব দেয় না তখন শিল্প, সাহিত্যের ভাষাও সংবেদনশীল হয় না। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘নারী জাতি যুক্তি বুঝে না, তারা সর্বক্ষেত্রে কেঁদে জিততে চায়’। সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের বিরাট অবদান থাকলেও এই বাক্যটির মাধ্যমে নারীর মেধাকে তুচ্ছ করা হয়েছে।
আবার বাংলা সাহিত্যের অনেক জায়গায় প্রকৃতির কোমলতার সাথে নারীর রূপ ও সৌন্দর্যকে তুলনা করা হয়েছে। ফলে নারীর রূপ সম্পর্কে একটা ধারণা আমাদের সবার মাথায় আসে যে নারী হবে সুন্দর, কোমল। অথচ প্রকৃতির কোমলতার সাথে পুরুষের রূপকে তুলনা করে সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি বললেই চলে। এর অর্থ দাঁড়ায়, কেবল নারীকেই হতে হবে কোমল ও নমনীয়।
শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, বিশ্বের আরও অনেক সাহিত্যে নারীর অবস্থানকে খাটো করা হয়েছে। যেমন ইংরেজি সাহিত্যের কিছু জায়গায় সন্তানকে Child না বলে Son বলা হয়েছে। অর্থ্যাৎ সন্তান মানে শুধু ছেলে, মেয়ে নয়। ইংরেজ কবি ও নাট্যকার শেক্সপিয়ার তার হ্যামলেট নাটকে দেখিয়েছেন, বাবার মৃত্যুর পর মা একমাসের মধ্যে ক্লডিয়াসকে বিয়ে করলে সন্তান বলেন, ‘Frailty thy name is woman’। এই কথার মধ্য দিয়ে সমস্ত নারীকে অবজ্ঞা করা হলো। তাছাড়া সন্তান তার মাকে অবজ্ঞা করতে পেরেছে, কারণ মা হলেন নারী। সুতরাং শিল্প, সাহিত্যও কখনও কখনও জেন্ডার নিরপেক্ষ না হয়ে পুরুষতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করে।
কিছু শব্দ কেবল নারীর জন্য
বেশ্যা–পতিতা:
বেশ্যা শব্দটি এসেছে ‘বৈশ্য’ শব্দ থেকে। বর্ণপ্রথার সময় হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রেণীকে বলা হতো বৈশ্য। সেখান এসেছে বাংলা বেশ্যা শব্দটি। যেসব মেয়ে টাকার জন্য কোন পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্কে জড়ায় তাদের বেশ্যা বা পতিতা বলা হয়। শুধু তাই নয়, যে মেয়েরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সমাজে স্বচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করে, নিজের পছন্দমতো পোশাক পরে, অনেক রাত অবধি বাইরে থাকে তাদেরকেও বলা হয় বেশ্যা বা পতিতা। বেশ্যা, পতিতা এই শব্দগুলোর কোন পুরুষবাচক শব্দ নেই। পতিতা বা বেশ্যা কেবল নারী হয়, আর যে ছেলেরা পতিতালয়ে যায় তাদের কোন নাম নেই।
পুরুষতন্ত্র নারীকে অবমাননা করার জন্য নানা ধরনের শব্দ সৃষ্টি করেছে এবং সেগুলোর ন্যায্যতা দিয়েছে। অথচ পুঁজিবাদী সমাজ যখন নারীর বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারে না, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে না তখনই একজন নারী পতিতালয়ে যায়। এটা নারীর দোষ না, সমাজ তথা রাষ্ট্রব্যবস্থার সমস্যা।
নারীর সতীত্ব:
নারীকে সতী হতে হবে। সমাজ মনে করে, সতীত্ব পুরুষের জন্য নয়। তাই ছেলেরা বিয়ে করার সময় কুমারী মেয়ে খোঁজে।
কোন কোন ধর্মগ্রন্থও নারীর সতীত্ব বজায় রাখার পক্ষে। বাংলা অভিধান প্রণেতারাও ভাষায় জেন্ডার সংবেদনশীল শব্দ ব্যবহার করেননি। যেমন ‘সতী’ শব্দটির অর্থ বাংলা একাডেমীর অভিধানে এভাবে করা হয়েছে- সাধ্বী, পরিব্রতা, স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষে আসক্ত নয় এমন, হিন্দু পুরাণের দক্ষ কন্যা, শিবানী, স্বামীর মৃত্যুতে সহগামিনী স্ত্রী। আর ‘সতীত্ব’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে: যৌন পবিত্রতা, সতী স্ত্রীর ধর্ম।
সমাজের দৃষ্টিতে যৌন পবিত্রতা বা সতীত্ব শুধুমাত্র নারীর জন্যই প্রযোজ্য।
মেয়েলি, পুরুষালি
আমাদের সমাজে মেয়েলি আর পুরুষালি শব্দের অর্থের মধ্য দিয়েও নারী ও পুরুষের প্রকৃতিগত ভিন্নতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। মেয়েলি কথাটি দিয়ে মেয়েদের আবেগী, যুক্তিহীন, কোমল ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলো জানান দেওয়া হয়। অপরদিকে পুরুষালি শব্দটি দিয়ে পৌরুষ, শক্তি, ক্ষমতা প্রকাশিত হয়। এর অর্থ হলো মেয়েরা আবেগ নিয়ে থাকবে, কোমল হবে। একারণে যখন কোন ছেলে কোমল আচরণ করে তখন তার স্বভাবকে মেয়েলি স্বভাব বলে উপহাস করে সমাজ।
এক ধরনের গালি দেওয়া অর্থে শালা বলা হয়। শালা মানে স্ত্রীর ভাই। স্ত্রীর ভাই আর গালি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। এরকম নানা শব্দ কিংবা গালির মাধ্যমে পুরুষআধিপত্যের প্রকাশ ঘটে ভাষায়।
নটী, নর্তকী
নটী শব্দটি গালি দেওয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়। অথচ নটীর বিপরীতে আছে নট। নট গালি দিতে ব্যবহার করা হয় না। নৃত্য যার উপজীবিকা তাকে বলা হয় নর্তকী। ছেলের পেশা নৃত্য হলে সেটির কোন নাম নাই।
পূর্বপুরুষ
পূর্বপুরুষ নামের একটি শব্দ থাকলেও পূর্বনারী বলে অভিধানে কোন শব্দ নেই। তার মানে হলো, বংশের ধারক বাহক কেবল পুরুষরাই হবে। নারীর কোন স্থান নেই সেখানে।
বিধবা
স্বামী মারা গেলে মেয়েদের বলা হয় বিধবা আর স্ত্রী মারা গেলে স্বামীর কোন নাম নেই। বিধবা নারী মানে অমঙ্গল, অকল্যাণ। এজন্য বিয়ে কিংবা কোন শুভ কাজের ক্ষেত্রে বিধবা নারীর উপস্থিতিকেও ঝামেলা মনে করা হয়।
প্রতিদিন যারা পাবলিক যানবাহনে চলাফেরা করেন তাদের প্রত্যেকেরই কমবেশি একটি অভিজ্ঞতা আছে, তা হলো- যেকোন ছোট কারণে একজন আরেকজনকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়। এই গালিগুলো নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। যৌন শব্দটিও এসেছে যোনি থেকে। যৌনতায় নারীর সক্রিয়তা সমাজ মেনে নেয় না। যৌনতা হয়ে দাঁড়ায় শুধুই পুরুষের সক্রিয়তার এলাকা, নারী সেখানে নিপীড়িত ও অনুষঙ্গ মাত্র।
ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘আমাদের সমাজে ভাষার মাধ্যমেও পুরুষের আধিপত্য বোঝা যায়। এই আধিপত্য আদিকাল থেকেই নারীর বিরুদ্ধে চলছে। কিছুটা পরিবর্তন ইদানিং দেখা গেলেও মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়নি। অভিধানের যে শব্দগুলো দিয়ে নারীকে ছোট করা হয় এবং পুরুষকে মহিমান্বিত করা হয় সেগুলো পরিবর্তন করা উচিত।
তিনি বলেন, শুধু নিরক্ষর না, অধিকাংশ শিক্ষিত পুরুষও নারীকে অবমাননা করার মতো শব্দ ব্যবহার করেন। তবে সম্প্রতি এদেশে জেন্ডারের ধারনা গড়ে উঠেছে কিছুটা। আর নারীরাও প্রতিবাদী হয়ে ওঠার কারনে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে।’
ধর্মীয় শ্লোক কিংবা শব্দ
ধর্মীয় মতাদর্শের ভাষাও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সংরক্ষণের পক্ষপাতী। যেমন: স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত। হিন্দুধর্মে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের যে কথামৃত আছে সেখানে সন্তান বলতে কেবল পুত্রকে বোঝানো হয়েছে। কন্যা সন্তানের কথা উল্লেখ করা হয়নি। যেমন-
- মাতৃভক্তি হয় অটুট যত, সেই ছেলে হয় কৃতি ততো
- পিতায় শ্রদ্ধা ও মায়ে টান, সেই ছেলে হয় সাম্যপ্রাণ
ধর্মগ্রন্থ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘ধর্মগ্রন্থেও বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে নারীকে ছোট করা হয়েছে। রামায়ণে রামচন্দ্র বলেছেন, ‘দেশে দেশে গেলে সীতা পাব, কিন্তু লক্ষ্মণ পাব না’। অর্থাৎ যেকোন দেশে সীতার মতো অনেক স্ত্রী পাওয়া যায়, কিন্তু লক্ষ্মণের মতো ভাই পাওয়া যায় না।’
প্রবাদ–প্রবচন ও বাগধারায় নারী
- পুরুষ রাগলে হয় বাদশা, নারী রাগলে হয় বেশ্যা
- নাও, ঘোড়া, নারী, যে চরে তারই
- লজ্জা নারীর ভূষণ
- পুরুষের বল টাকা, নারীর বল শাঁখা
- সতী নারী গঙ্গা জল, অসৎ নারী বদ্ধ জল
- সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে, রমনী সুন্দর হয় সতীত্ব রক্ষণে
- বাপ কা বেটা
- চোরের মায়ের বড় গলা
- মাছের মায়ের পুত্রশোক
এই প্রবাদগুলো আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। সবগুলো প্রবাদেই নারীকে চরমভাবে অপমান করা হয়েছে।
প্রবাদ প্রবচনে নারীর অবমাননা প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘পুরুষ মারা গেলে শোক প্রকাশ করার মানুষের অভাব হয় না। যেমন, মাছের মায়ের পুত্রশোক। আর নারী মারা গেলে সেটা সৌভাগ্য মনে করা হয়। এই ভাবনা থেকে প্রবাদ এসেছে, ‘অভাগার গরু মরে, ভাগ্যবানের বৌ মরে’। একটি জাতি গরুর চেয়েও নিজের স্ত্রীকে তুচ্ছ মনে করে। এছাড়াও ডাইনী, পেত্নী ইত্যাদি শব্দগুলোর মাধ্যমে নারীর চরম অবমাননা করা হয়। আর যারা মেয়েদেরকে উদ্ধার করে আনে তাদেরকে রাজপুত্র উপাধি দেওয়া হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজা ইয়াসমীন বলেন, ‘এদেশের ভাষা প্রথম থেকেই পুরুষতান্ত্রিক। এজন্য আমাদের সমাজ ও মানুষের মানসিকতা দায়ী। এই দুটি জায়গায় পরিবর্তন দরকার। প্রথমত মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। তাহলেই সমাজের পরিবর্তন হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ২০ শতকের দিকে জেন্ডার সংবেদনশীলতার ধারণা শুরু হয়। ফলে এই ধারণা খুব বেশিদিন আগের না। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু বিভাগে জেন্ডার কোর্স পড়ানো হয়। ফলে ধীরে ধীরে নতুন প্রজন্মের চিন্তায় কিছুটা পরিবর্তন আসছে। যদিও এই পরিবর্তন খুব বেশি না। মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন হলে ভাষায়ও সংবেদনশীলতা আসবে।’
পুরুষের জন্য প্রশংসাসূচক শব্দগুলো হচ্ছে- শৌর্য বীর্যের অধিকারী, উচ্চাকাঙ্খী, বলবান। আর নারীর প্রশংসায়- মিতভাষিণী, সুহাসিনী, পতিপরায়ণা, সুদর্শনা ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ নারী হবে দুর্বল। মেয়েরা সারাক্ষণ চোখের জল ফেলবে, পুরুষের কথা মতো কাজ করবে, সংসার সামলাবে আর বাচ্চা জন্ম দেবে- এসব অর্থেই নারীর প্রশংসাসূচক শব্দগুলো এমন হয়েছে।
বাংলা ভাষায় ধীরে ধীরে জেন্ডার সংবেদনশীলতা আসছে কিনা জানতে চাইলে ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘সম্প্রতি ভাষাগত জায়গায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন কিছু কিছু জায়গায় সভাপতিকে ‘সভাপ্রধান’ ও চেয়ারম্যানকে ‘চেয়ারপার্সন’ বলা হচ্ছে। তবে এগুলো একদিনে হয়নি। এই পরিবর্তনগুলোর পেছনেও অনেক মানুষের প্রচেষ্টা আছে। যেমন কুমিল্লার নওয়াব ফয়জুন্নেসাকে যখন বৃটিশরা চৌধুরাণী উপাধি দিতে চেয়েছিল, তখন তিনি নিজেই এর প্রতিবাদ করেছিলেন এবং এই উপাধি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ‘নওয়াব’ উপাধি না দিলে তিনি এই উপাধি গ্রহণ করবেন না বলে জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাকে নওয়ার উপাধি দিতে বাধ্য হয় ইংরেজরা।’
অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ আরও বলেন, নারী-পুরুষ সবাইকে ভাষার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তবে যতদিন পর্যন্ত সমাজে নারী, পুরুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখার মানসিকতা তৈরি হবে না ততদিন পর্যন্ত ভাষাগত সচেতনতা আসবে না। যে ভাষাগুলো নারীকে অপমান করে সেগুলো পুরুষের দৃষ্টি থেকে তৈরি হয়েছে। তবে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনার মধ্য দিয়ে এই জায়গায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। যেমন: স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রীস্বাধীনতা শব্দগুলো এখন ব্যবহার করা হয় না। এই জায়গায় নারীশিক্ষা, নারী স্বাধীনতা বলা হচ্ছে। আজকাল কিছু সচেতন মানুষ মেয়েদের মহিলা না বলে নারী বলছেন।’
তিনি বলেন, ‘ভাষা বলা ও লেখার ক্ষেত্রে সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে। পাঠ্যপুস্তকেও জেন্ডার সংবেদনশীল শব্দ ব্যবহার করতে হবে।’
অলঙ্করণ- আবু হাসান
সারাবাংলা/টিসি/ এসএস
অবমাননা নারী পতিতা পাঠ্যপুস্তক পুরুষতন্ত্র ভাষা ভাষার ইতিহাস সতী