বাক্সবন্দি
৪ নভেম্বর ২০১৮ ১০:২২
মানুষ যখন চালাকি করবার চেষ্টা করে, তখন তাকে দেখতে যে কি বোকা লাগে – সায়েরা আপা এমনটাই ভাবছেন এ মুহূর্তে। সামনে দাঁড়ানো দেলোয়ার। বাড়ির লিফটম্যান, অবসরে এ বাসার কেয়ারটেকার। কি অবলীলায় দেলোয়ার মিথ্যা ঢাকার চেষ্টা করছে। আঙ্গুল উঁচিয়ে কথা বলছে, জোর গলায় কথা বলছে। কিন্তু চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেনা। চালাকি করলে মানুষ ঠিক এমনটাই করে।
সায়েরা আপা চালাকি জিনিষটা সহ্য করতে পারেননা। কিন্তু আসে পাশে ইদানিং সবাই যে চালাকি নামক এক অদৃশ্য লেবাস পরে ঘুরে বেড়ায়, সায়েরা আপার তা ভালো লাগেনা। ভালো লাগছেনা অনুভুতিটি আসলে সাদামাটা, মৃদু। অসহ্য লাগছে, ভেঙেচুরে ফেলতে ইচ্ছে করছে – অনুভূতিটা যথার্থ। এই যেমন এই মুহূর্তে।
দেলোয়ার কে ৭৫০০ টাকা দেয়া হয়েছে জিনিষটা কেনার জন্য। সে দেশে যাবে, দেশ থেকে নিয়ে আসবে। সাথে আসা-যাওয়ার খরচ বাবদ আরো ৫০০ টাকা। এখন সে এসে জানাচ্ছে, জিনিসটা পাওয়া যায়নি, কিন্তু সে অগ্রিম টাকা দিয়ে এসেছে একজনকে। আগামী মাসে জিনিস ডেলিভারি হয়ে যাবে বাসার দরজায়। তখন রাগ হয় কিনা?
এ মুহূর্তে আসেপাশে কাউকে বিশ্বাস করা তো কঠিন। দেখছেন তো তিনি প্রতিদিন। এই সেদিনের ঘটনা, নিজের চোখে দেখা – একজন দেবর, খাওয়াতে বিষ মিশিয়ে ভাবীকে খুন করার চেষ্টা করলো। ভাগ্গিস ঠিক সময়ে, ভাবী দেখে ফেলছিলো, পুলিশকে খবর দিলো। নাইলে তো বিষ খেয়ে মরতে হতো। প্রতিদিনই তো দেখছেন এসব।
সায়েরা আপার বর থাকেন বিদেশ। এ দেশ, ও দেশ অনেক দেশ ঘুরে চাকরি। মোটকথায় বিদেশে তার বাস। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, শ্বশুরবাড়ি, মা-বাবার বাড়ি এসব টানে দেশেই থাকেন সায়েরা আপা। নাইলে তিনিও তো পারতেন বরের সাথে এ দেশ ও দেশ ঘুরতে। সোবহান ভাই, মানে সায়েরা আপার বর দূর থেকে সংসারের ঝামেলা মেটান, ফোনে ফোনে । বছরে দু -তিন বার দেশে আসেন। আর নিজ হাতে কাছ থেকে সব সামলে নেন সায়েরা আপা।
কিন্তু ইদানিং, আসে পাশে তো কাউকে বিশ্বাস করা যাচ্ছেনা। বড্ড চিন্তা হয়। বিপদ যাতে না ঘটে, সে সমাধানের জন্যই দেলোয়ারকে একটি বিশেষ জিনিস আনতে দিয়েছিলেন। জিনিসটা পেলে নাকি বালা মুসিবত থাকেনা সংসারে । আনতে তো পারলোনা, উপর দিয়ে এক গাট্টি টাকা নষ্ট। বাড়ির সবাই জানতে পারলে রাগ করবে। এ বাড়িতে তাদের তিনজনের সংসার। সায়েরা আপা, সাফিন আর মারিয়া। মা-ছেলে-মেয়ে।
সায়েরা আপার ছেলে মেয়ের কোনো বৈশিষ্ট আলাদা করে বলার নেই। এ বয়সের কলেজ ইউনিভার্সিটি’র ছেলে মেয়েরা যেমন হয় তেমনি। নিজের মতন, নিজের ভাবনায় গড়া। জীবনে তাদের অভাব নেই, প্রয়োজন আছে অনেক। প্রতিদিনের মতন যে যার সমস্যা নিজে পাশ কাটিয়ে চলছে, আর সবার মতন, চেনা সুরের শহুরে জীবনে। আলাদা কিছুনা।
কিন্তু সায়েরা আপার মন খচখচ করে। দিনকাল তো ভালোনা। সেদিন এক ভদ্রমহিলার মেয়ে বাড়ি থেকে বের হলো কলেজ যাবে বলে। কিছুক্ষন পর বাড়িতে ফোন এলো, মেয়েকে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ। কলেজ যাওয়ার পথে মারপিট করেছে রাস্তায়। সায়েরা আপার নিজের চোখে দেখা।
ছেলে মেয়ের দিকে তাই বিশেষ খেলায় রাখতে হয়। বাজে অভ্যাসে আবার না জড়ায়। সেদিন দেখেন মেয়ের টেবিলে ছোট এক শিশিতে রাখা সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো মিহি দানা। বুক খামচে ধরলো কেউ যেন। ভয়ে, আশংকায়। তবে কি তার মেয়েও কোনো অন্যায় করছে। মেয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে মাকে দেখে অবাক। “তুমি আমার মেকআপ ঘাটাঘাটি করো কেনো মা?”
“এই সাদা সাদা জিনিস মেকআপ?”
“হ্যাঁ মেকাপ সেটিং পাউডার। আমার কাছে ঐটুকুই আছে। রাখো। হাত থেকে পরে যাবে। ”
সায়েরা আপা সেদিন আর কথা বাড়ালেন না। কিন্তু সন্দেহ ও মন থেকে গেলোনা। সত্যিই কি মেকাপ পাউডার নাকি অন্য কিছু শিশিতে?
সবকিছু নিয়ে ভারী চিন্তায় থাকেন সায়েরা আপা। এর মাঝে দেলোয়ার গত দু’দিন মোবাইলে ফোন দিচ্ছে, অথবা, দরজা ধাক্কাচ্ছে দুপুরে এসে, যখন বাড়িতে কেউ নেই। নিশ্চয়ই আরো টাকা নেবার ধান্দা।
আজ যখন দুপুরে এসে আবার দরজার সামনে এসে “খালাম্মা খালাম্মা দরজা খোলেন” শুরু করলো, সায়রা আপা বিরক্ত হয়ে দরজা খুললেন। জিনিস তো আনতেই পারলোনা, এখন নানা অজুহাত দেখিয়ে আরো টাকা হাতানোর ধান্দা। আরো টাকা চাইলে আজকে কঠিন ভাবে ঝাড়ি দিবেন।
বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো দরজার ওপারে। দেলোয়ারের হাতে ছোট্ট কাদের বাক্স। “খালাম্মা, দুইদিন ধরে আপনারে খুঁজি, অসুখ বিসুখ করলো নাকি ভাবলাম।”
সায়েরা আপা কিছু বলছেনা। এক দৃষ্টিতে বাক্সের দিকে তাকিয়ে আছে। দেলোয়ার নিজেই পাল্টা বললো, “খালাম্মা, আমি এক জবানের মানুষ। নেন, আপনার জিনিস।”
সায়েরা আপার ভয়ে আর আনন্দে চোখ ভিজে গেলো। “সত্যি আনছো, সত্যি!”
খুশির চোটে দেলোয়ার কে ১০০ টাকা বকশিস দিয়ে দিলেন সায়েরা আপা। এ জিনিস থাকলে বাড়িতে বিপদ আপদ আসেনা। তিনি দেখেছেন নিজ চোখে। এ জন্যই তো এতো কষ্ট করে নিজ বাড়িতে আনা।
এরপরের দু’দিন ঘোরে, লুকোচুরিতে কেটে গেলো। বাড়ির সবার সাথে লুকোচুরি। বাড়ির সবার ভালোর জন্যই। এই লুকোচুরি প্রয়োজন।
লুকোচুরিতেই কাটতো, যদি না ঘটনাটা না ঘটতো। বিকালের মুখে, প্রথমে বাড়ি ফিরলো সায়েরা অপার কন্যা, মারিয়া। ইউনিভার্সিটি থেকে। দরজা দিয়ে ঢুকে দেখে, সায়েরা আপা সোফার কোণায় মা উঠিয়ে কাঁচুমাঁচু ভঙ্গিতে বসে আছে। পাশের সোফায় পা উঠিয়ে একই ভঙ্গিতে সাফিন। উল্টোদিকের কাঠের চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে আছে বুয়া। ঘটনা সামাল দেয়ার জন্য দেলোয়ারকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু সে কোনো কাজেই আসলোনা। মারিয়া কলিংবেল টেপার পর, দেলোয়ার দরজা খুলে দিলো। এখন সেও বুয়ার পাশে একটি চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে আছে।
“কি ঘটনা কি? সবাই এমন করে বসে আছো কেন?” মারিয়া খানিকটা বিরক্ত এবং অবাক।
-“কিছুনা, তুই এসে পা উঠিয়ে বস। আমার পাশে এসে বস।”
” প্রশ্নই উঠেনা, আমার এসাইনমেন্ট করতে হবে। তোমরা সবাই পা উঠিয়ে বসে আছো কেন?”
-“বস আগে, তারপর বলি। ”
“পারবোনা। বুয়া আমাকে চা দেন এক কাপ।”
বুয়া ভীত ভঙ্গিতে চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে আছে। উত্তর দিলোনা।
“কি ঘটনা কি মা?”
সায়েরা অপার লুকোচুরি করার আর উপায় নেই। না বললেই এবার বরং বিপদ।
“আরে সাপ। সাপ, ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন কই আছে বুঝা যাচ্ছেনা। তুই উঠে বস মা। ছোবল টোবল দিলে। তোর বাপ দেশে নাই।”
বাবার দেশে থাকার সাথে সাপের ছোবল দেয়ার কি সম্পর্ক তা মারিয়া না বুঝলেও, পা উঠিয়ে মায়ের পাশে বসলো। সাপের ছোবল কে খেতে চায়।
এ ঘটনা, সে ঘটনা, বহু ঘটনার পরেও যখন সাপকে আসে পাশে খুঁজে পাওয়া গেলোনা, তখন মনে পড়লো সায়েরা আপার বড় বোন জাহেরা আপার কথা।
না, জাহেরা আপা আক্ষরিক অর্থে সাপুড়ে নন। কিন্তু প্রতি ফ্যামিলি তে একজন ওঝা ধরণের সবজান্তা অভিভাবক ধরণের আত্মীয় থাকেনা? জাহেরা আপা তেমন। সায়েরা আপার বড় বোন।
কল সারানোর মিস্ত্রি থেকে শুরু করে ইএনটি ডাক্তারের নম্বর সব পাওয়া যায় ওনার কাছে। এ ধরণের ওঝা গোছের উপকারী আত্মীয়রা আন্তরিক হন। নিজে কথা বলতে পছন্দ করেন, অপরের কোথাও মন দিয়ে শোনেন।
আয়োজন করে, আসর বসিয়ে জাহেরা আপা ঘটনা উদ্ধার করলেন। বাড়িতে সাপ এলো কিভাবে?
সায়েরা আপা পুরো ঘটনায় ভীত এবং লজ্জিত। একটি ভালো ঘটনা কেমন করে অঘটন হয়ে গেলো। এই লজ্জায় তিনি লজ্জিত। এবং সাপের ছোবলের ভয়ে ভীত। তারপর ও যতটুক খুলে মেলে ঘটনাটা বলা যায় বললেন। ঘটনা শুনে সায়েরা আপার দুই ছেলে মেয়ে মারিয়া স্তব্ধ। বাড়িতে এতো কিছু চলছে, তারা কিছুই জানেনা?
এবং জাহেরা আপা বিস্মিত। ছোটবোন সায়েরা আপাকে আবার প্রশ্ন করলেন,
“তোর মনে হচ্ছে তোর বাড়িতে ষড়যন্ত্র চলছে?”
– “না তা বলিনি। ষড়যন্ত্র কেন হবে? কিন্তু আসে পাশে যা বিপদ। মানে এই বয়সের ছেলে মেয়ে, বাপ ও বিদেশ থাকে। কখন কি ঘটিয়ে ফেলে। তাই আগে থেকে সাবধানতা। সিরিয়ালে দেখায় না, ওই দেবর ভাবীকে বিষ খাওয়ায় দিয়েছে, তারপর এই মারিয়ার বয়সী মেয়েরাও এখন রাস্তায় যেয়ে মারপিট করে, আজেবাজে জিনিস খায়। চারপাশে তো খালি বিপদ আর বিপদ। সিরিয়াল দেখলে তো জানা যায় আপা ….”
“তুই কয়টা সিরিয়াল দেখিস?”
-“বেশি দেখিনা আপা। এই সন্ধ্যা ৭.৩০ থেকে রাত ১২ তার মধ্যে যে কয়টা হয়। তার মধ্যে ও ২/৩ টা মিস যায়।”
“বলিস কি তুই? তোর এই সিরিয়ালের সাথে সাপের কি সম্পর্ক?”
-“ও ও ওই সাপ সওদাগর”
“সাপ সওদাগর কে? কে সে?”
-“ওই সিরিয়াল দেখায়না? সাপ সওদাগর। ঐখানে দেখালো সাপ পুষলে, বাড়িতে বিপদ আসেনা। চারপাশে কত ধরণের বিপদ। ”
জাহেরা আপা মনে হয় এমন চমকপ্রদ উত্তর আশা করেননি। অহেতুক কয়েকটা ঢোক গিললেন এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা ধরণের একটা লম্বা কাশি দিলেন।
“সাপ সওদাগর জিনিষটা কি?”
-“হায় হায়, তুমি এই সিরিয়ালের নাম শোনোনি, ৩৪৭টম পর্ব দেখাচ্ছে। খুব পপুলার।”
“তুই সিরিয়াল দেখে বাসায় সাপ আনছস? বলা মুসিবত দূর করার জন্য? আমার বোন হয়ে তুই এতো মূর্খ কেমনে হলি?”
-“না মানে ভাবলাম। এক্সপেরিমেন্ট করে দেখি আর কি। দেলোয়ার বললো ওর পরিচিত লোক আছে সাপ সাপ্লাই দেয়। এনে দিলো। দুইদিন তো ভালোই ছিল আপা। কেউ টের পায়নি। আজকে ভুলে বাক্সের দরজা খুলে ফোন ধরতে গেলাম এই ফাঁকে মনে হয়ে বের হয়ে গেছে।”
খালা আর মায়ের প্রশ্নোত্তর পর্ব শুনে সাফিন বস্বগোক্তি করে, “ও মাই গড, ও মাই গড। ”
একেই বলে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনা। জাহেরা আপার চোখ এখন সাফিনের দিকে।
“কিরে সাফিন তোর ঘাড় এমন বাম দিকে হেলানো কেন?”
-“ইয়ে খালা ঘাড়ের রগে টান পরেছে। ডান দিকে তাকাতে পারছিনা। ”
“এই বয়সে রগে টান খেলি কিভাবে?”
“আর বলোনা খালা, ট্যাবটা সেদিন হাত থেকে মাটিতে পরে গেলো, সোফা থেকে লাফ দিয়ে উঠে ট্যাব তুলতে গেছি , তারপর থেকে এই অবস্থা।”
জাহেরা আপা নিরুত্তর। বড় বড় নিঃস্বাস ফেলছে। ফোন বের করে কার নম্বর যেন খুঁজছেন। তার পরিচিত সাপুড়ে আছে। ডাকা হলো তাকে। খুঁজে পাওয়া গেলো সেই সাপ। বারান্দার গ্রিলের সাথে পেঁচিয়ে দোল খাচ্ছিলো। সাপ দেখে জাহেরা আপার ছি ছি অবস্থা।
“এই পিচ্চি সাপ? এর ভয়ে তোরা কাতর? এর তো দাঁতও নাই। এর জন্য এতো টাকা খরচ করসিস? দেলোয়ার তুই সাপ আনলি যখন ভালো দেখে আনবিনা? ”
জাহেরা আপা যাওয়ার আগে জানিয়ে গেলেন, যে এই বাড়িতে সাপ প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন ওঝার। তিনি সেই ওঝার দায়িত্ব পালন করবেন। যাওয়ার আগে ছোট বোন সায়েরা অপার হাতে একটি চিরকুট, এবং ভাগ্নে সাফিনের হাতে একটি চিরকুট দিয়ে গেলেন।
“শোন এখানে তোদের জন্য মন্ত্র লেখা আছে। একদম নিয়ম মেনে ফলো করবি। অন্যথায় আমি কড়া ব্যবস্থা নিবো।”
জাহেরা আপা সাপ নিজের সাথে নিয়ে বিদায় নিলেন।
সায়েরা আপা আর সাফিন কেউ কারো চিরকুট কাউকে দেখায়নি। দেখানোটা ঠিক সম্মানজনক হতোনা।
সায়েরা আপার চিরকুটে লেখা ছিল, “সোপ অপেরা নিছক বিনোদন মাত্র। একে নিজের জীবনের সাথে মিলাবিনা। সোপ দেখে সাপ পোষা আহাম্মকি ছাড়া আর কিছুই নয়। অতি মাত্রায় সোপ অপেরা আসক্তি, মাদকাসক্তির মত। চারপাশে খালি গোলাপি হাতির স্বপ্ন দেখায়। অবাস্তব। খবরদার, দিনে একটার বেশি সোপ অপেরা দেখবিনা । একটার বেশি সোপ অপেরা দেখলে, সাপ কে আবার তোর বেডরুমে এনে ছেড়ে দিবো। বুঝবি মজা তখন।”
সাফিনের চিরকুটটা এমন ,” শোন সাফিন তোকে সেদিন দেখলাম তোর কোচিঙ এর বাইরে লাল রঙের চুলের এক মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছিস। সামনে পরীক্ষা না? এই বয়সে তুই? দিনে এক ঘন্টার বেশি ট্যাব হাতে নিয়ে ঘুরঘুর করলে, ঘটনা বাসায় বলে দিবো। সেটা কি ভালো হবে?”
জীবনতো আর সিরিয়াল না। যে চিরকুটের ভয়ে সায়েরা আপা সিরিয়াল দেখা ছেড়ে দিবে। আর কোচিং শেষে সাফিন লাল রঙের চুলের সেই মেয়ের সাথে ফুচকা খাওয়া বন্ধ করে দিবে। জীবন চলে জীবনের মতন – কখনো হেলেদুলে আরামে, কখনো উর্দ্ধশ্বাসে বিরতিহীন। জীবন চলে জীবনের মতন। চলতে চলতে পথের মধ্যের স্পিব্রেকার গুলো, হয়তো গতি খানিকটা থামিয়ে দেয়। ভাবায়। সাবধানী করে।
এই সাপ-সংক্রান্ত ঘটনার পর, আপাতদৃষ্টিতে সব আগের মতো করে চলে। কিন্তু মা-ছেলে- মেয়ের গল্পের আসরের উপাদান তৈরী হয়, একসাথে আসর জমানোর নিমিত্ত তৈরী হয়, কিংবা তারা সচেতন ভাবে তৈরী করে নেয়। গল্পের ছলে, সায়েরা আপা সন্তানদের কাছে স্বীকার করেন তার সাপ নিয়ে ঘটনাটা বাড়াবাড়ি হয়েছে। সবই এই সোপ অপেরার রঙিন আজগুবি গল্পের দোষ। সেই সাথে মা এবং ছেলে-মেয়ে একমত হয় যে জাহেরা আপা ঐদিন একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। হোক সে মুরুব্বি, তাই বলে সবার সামনে তাদের মূর্খ বলে গালিগালাজ করবে? এবং তিনজন মিলে এই সিদ্ধান্তেও আসেন তারা যে দেলোয়ার ব্যাটা এই পুঁচকে সাপের দাম অনেক বেশি রেখেছে। ঠকিয়েছে তাদের।
এমন গল্পের সূত্র ধরে তাদের আরো অনেক গল্প তৈরী হয়। না বলা গল্প, বলা গল্প, অণু গল্প, গল্পের গল্প। গল্প শেষে, মা-মেয়ে-ছেলে আকাশ দেখে। বিকেল সন্ধ্যার মিলমিশের সময়টাতে যখন সূর্য নরম কুসুমের মতন গলে গলে আকাশে মেশে, তারা তিনজন মুগ্ধ চোখে তখন আকাশ দেখে, ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে, গল্পের ফাঁকে।
সাফিন ছেলেমানুষি কণ্ঠে মাঝে মাঝে বলে, “কি সুন্দর, আমরা এমন স্কাই পাতায়াতে দেখেছিলাম, না? ওয়াও একই রকম। তাইনা?”
কেউ সে কথার উত্তর দেয়না। কেউ সে কথার উত্তর চায়ও না বোধহয়। কিন্তু তারা তিনজন মিলে আজকাল গল্পের ফাঁকে আকাশ দেখে। বাক্সবন্দী এ শহরে, সন্ধ্যের মুখে তিনজোড়া অসমবয়সী চোখ, বিস্ময়ে আকাশ দেখে। যে যার মতন করে আকাশ দেখে।
কিযী তাহনিন: গল্পকার, উন্নয়ন ও সেবাকর্মী। ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার বাংলাদেশ কার্যালয়ে কর্মরত
[প্রিয় পাঠক, কিযী’র জানালা থেকে সারাবাংলা.নেট এর একটি নতুন আয়োজন। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন উপরের গল্পটি নিছক কোনও গল্প নয়, এটিই সমাজের এক ভয়ঙ্কর চিত্র। কিযী তাহনিন তার গল্পগুলোয় এমন সমাজের সমস্যা, সঙ্কট, ভয়াবহতা তুলে ধরবেন গল্প বলে বলে। আশা করি এর মধ্য দিয়ে হয়তো সচেতন হয়ে উঠবে সমাজ, পাল্টাবে মানুষগুলোর মন-মানসিকতা।]
সারাবাংলা/এসএমএন