তরুণ স্থপতি পিউলির নকশায় প্রকৃতি ও প্রাণের সমন্বয়
৫ নভেম্বর ২০১৮ ০৮:৫৩
।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর ।।
ঢাকা: ঢাকার ব্যস্ততম পথে যদি মাঝ বরাবর একটা খাল কেটে বেদেরা নৌকা নিয়ে বাস শুরু করে বলে তারা এসেছে ঢাকা দেখতে কিন্তু তারা নিজেদের অভ্যাসের আয়েস চায়? অথবা এস্কিমোরা সাহারা মরুভূমি বেড়াতে যাওয়ার সময় সেখানে বরফ দাবি করে? কেমন হবে তাহলে তাদের পর্যটন?
অথচ এই কাজটাই আমরা করছি হরহামেশা। পর্যটনের নামে বনের মধ্যে বিশাল দালান তুলে বানিয়ে ফেলছি একটি একটি শহর, সেখানে গিয়ে থাকছি নিজেদের শহুরে মেজাজে। বনের তো ক্ষতি হচ্ছেই, ব্যাহত হচ্ছে সেখানে স্থানীয়দের জীবন।
পিউলি ছোট্ট একজন স্থপতি। অবশ্য তাকে ঠিক স্থপতিও বলা যায় না, কারণ কাগজে-কলমে এখনও স্থপতি হয়ে উঠেননি পিউলি। মাত্র বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় সর্বশেষ পরীক্ষা দিয়েছেন। আর সেই পরীক্ষার অংশ হিসেবে করা ডিজাইনটায় নজর কেড়ে নিয়েছেন নাজিফা তাবাসসুম পিউলি।
পিউলির ডিজাইনটা ছিল বান্দরবনের থানচি উপজেলার পর্যটন পরিকল্পনা নিয়ে। পিউলি তার ডিজাইনে দেখিয়ে দেন, কীভাবে ওই এলাকার ঐতিহ্য, প্রকৃতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে পর্যটন এলাকা পরিকল্পনা করা যায়।
পিউলির কাজ নিয়ে তার কাছে শোনার আগে আমরা বরং শুনি হাতিরঝিল, ধানমন্ডি লেক, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধের স্থপতি ইকবাল হাবিব কী বলেছেন পিউলির এই ডিজাইন সম্পর্কে।
ইকবাল হাবিব পিউলির ডিজাইনে একজন জুরি ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা নিজের মতো করে অন্যের প্রয়োজন, চাহিদা, প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশকে চিন্তা করতে পছন্দ করি। একজন স্থপতি হিসেবে এটা একটা ধৃষ্টতা, অন্যায়। পিউলির ডিজাইনে আমরা দেখেছি, সে খুব সংবেদনশীলতা এবং দায়িত্বের সঙ্গে বান্দরবন এলাকার প্রকৃতি ও মানুষকে যুক্ত করেছে। চাপিয়ে দেওয়া মানসিকতার সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে তার এই অন্তর্ভুক্তিমূলক মানসিকতার প্রয়োগ আমাকে মুগ্ধ করেছে।
পিউলি মানুষ হিসেবে খুব সংবেদনশীল। মেয়েটি শুধু মেধাবী প্রকৌশলীই নয়, ভালো গানও করেন, বেশ কয়েকটি বাজনাতেও সিদ্ধহস্ত। কীভাবে এই দারুণ পরিকল্পনাটা এলো পিউলির মাথায়? জানতে চাইলে সহজ জবাব, বান্দরবনকে যদি সুন্দর করে পরিকল্পনার মধ্যে বাড়তে না দেওয়া হয়, তাহলে তো বান্দরবন অন্য সব পর্যটন এলাকার মতো নষ্ট হয়ে যাবে।
তাই পিউলি থানচি বাজার ঘিরে সুন্দর একটি পরিকল্পনা করেছেন। তার পরিকল্পনায় সেখানে শুধু পর্যটকদের আবাস হবে না, গোছানো বাড়িঘর তৈরি হবে, দোকান হবে, তাঁতিদের জন্য জন্য আবাস হবে। আর সেখানে সবকিছুকে যুক্ত করবে একটি পাকা পথ, যেটি ধরে পর্যটকরা হেঁটে হেঁটে বান্দরবনকে জানতে পারবেন, সেখানকার মানুষদের জানতে পারবেন, তাদের পেশা সম্পর্কে জানতে পারবেন। এভাবে ওখানে থাকার মানুষদের প্রতি পর্যটকদের একটা শ্রদ্ধা তৈরি হবে।
পিউলির বড় করে ডিজাইনের বাড়িঘরগুলো সব বাঁশ আর দেশজ উপকরণের, যা ওই এলাকায় সহজলভ্য। শুধু তাই নয়, এই ঘরবাড়িতে একটা পেরেক পর্যন্ত ব্যবহৃত হবে না। পিউলি বলে, এটাই ওই এলাকার বাড়িঘরের বৈশিষ্ট্য। সেখানে ঘরবাড়ি তৈরি হয় বাঁশের জোড়া দিয়ে দিয়ে। হরেক রকমের জোড়ার ওপর বিশদ গবেষণাও করেছেন তিনি। এভাবে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে একটি পেরেকও ব্যবহার না করে বানিয়ে ফেলা যায় একটা আস্ত বাড়ি।
পিউলির কাজের আরেকটি দর্শনীয় বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি বাড়িই হবে মাচার ওপর। এতে মাটির উপরে গুল্ম-লতার আস্তরণ থাকবে। মাটি ক্ষয়, ঢল ইত্যাদি থেকে ওই মাটিকে রক্ষা করবে এই মাচা। ওদিকে ঘরের চালায় রাখা হয়েছে অনেকগুলো জানালা। এতে আলো আর বাতাসের প্রাচুর্য তো হবেই, ঝড়ো হাওয়া এলেও সবগুলো জানালা খুলে বাতাস বের হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করায় রাক্ষা পাবে ঘরগুলোও।
ওদিকে, নদীর পাড় ধরে স্থাপত্যগুলো নেমে যাবে চমৎকার একটি কোণ নিয়ে। এ বিষয়টি ঠিক কেমন— জানতে চাইলে পিউলি জানান, আমি চেষ্টা করেছি একটি আর্কিটেকচারাল ইল্যুশন তৈরি করার, যেন দেখে মনে হয় বাড়িগুলো নদীর ঢাল বেয়ে নেমে গেছে। কিন্তু এগুলো আসল সোজা, এখানে কোনো ঢাল নেই। ঢাল তৈরি করার উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা তৈরি করা। সারাজীবন ঢাল দেখে আসা একটি মানুষের চোখে যেন আরাম লাগে।
পিউলির এই ডিজাইন এরই মধ্যে প্রশংসা পেয়েছে অনেক। শিক্ষকরা তো এটাকে সর্বোচ্চ গ্রেড দিয়েছেনই। স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, আমরা টেকশই উন্নয়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি। এই লক্ষ্যে নতুন দিনের পেশাজীবীদের এমন ভাবনা সত্যিই আশার সঞ্চার করে।
সারাবাংলা/এমএ/টিআর