ছেলে সন্তানের জন্য কেন এত আকাঙ্ক্ষা?
১৩ নভেম্বর ২০১৮ ১৫:২৩
তিথি চক্রবর্তী।।
আয়েশা আক্তার (৪৪) তিন মেয়ের মা। প্রথম দুটি সন্তান মেয়ে হওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে তাকে নানাভাবে অপমান করা হত। এমনকি স্বামীও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন না। নানা ধরনের মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে ছেলের আশায় ৪১ বছর বয়সে আবার তৃতীয় সন্তান নিতে তিনি বাধ্য হন। কিন্তু তৃতীয় সন্তানও মেয়ে হয়। এরপর আয়েশার প্রতি লাঞ্ছনা আর অপমান সীমা ছাড়িয়ে যায়। তাছাড়া বেশি বয়সে সন্তান নেওয়ায় শারীরিক নানা অসুবিধায় পড়েন আয়েশা। তিনি বলেন, ‘প্রথম দুটি সন্তান মেয়ে বলে বেশি বয়সে আবার বাচ্চা নিতে বাধ্য হই। এতে একদিকে যেমন শারীরিক কষ্ট, অন্যদিকে মানসিক। এই কষ্টের ভাগিদার কেউ নয়, এমনকি আমার স্বামীও না।’
আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ ছেলে সন্তান চায়। মেয়ে সন্তান অনাকাঙ্খিত। কারণ পুরুষ মানেই পরিবার ও সমাজের কর্তা। আর পুরুষের কর্তৃত্ব, প্রভুত্বকে মান্য করে নারী। সামাজিক রীতি অনুসারে, মেয়ে বিয়ে করে অন্য একটি পরিবারে চলে যায়। সমাজের সকল অসঙ্গতি মেনে নিয়ে সংসার করে। আর ছেলে সন্তান পরিবারের হাল ধরে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয়। বৃদ্ধ বাবা মাকে দেখে। এই ধরনের চিন্তার ভিত্তিতেই সমাজে নারী, পুরুষের অবস্থান।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে আসলেই কি মেয়েরা পরিবারের অর্থনৈতিক বিষয়টি দেখভাল করতে পারে না? বৃদ্ধ বাবা মায়ের দায়িত্ব নিতে পারে না? নাকি তাদের এসব করতে দেওয়া হয় না?
যুগ যুগ ধরে সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা বিদ্যমান। কর্তৃত্ব যেন পুরুষের হাতে থাকে এজন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্ত ক্ষেত্রে নারীকে অবদমিত করে রাখা হয়েছে। অধিকাংশ পরিবারে ছেলে সন্তানকে বেশি সুযোগ ও স্বাধীনতা দিয়ে বড় করা হয়। আর মেয়ের ক্ষেত্রে থাকে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। কারণ ছেলে সন্তান ভবিষ্যতে পরিবারের দায়িত্ব নেবে, এই ভাবনা থেকে ছেলের আবদারগুলো ইতিবাচকভাবে দেখা হয়।
বেশিরভাগ বাবা-মা ছেলের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য বলেন, ‘তোমাকে পারতে হবে বা তুমি পারবে।’ অন্যদিকে মেয়েকে বলেন, ‘সহ্য করো, মেনে নাও’। পরিবারে ছেলেদের মতামতের অনেক দাম। অনেক সময় পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মায়ের চেয়ে ছেলের কথায় গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি। এভাবে ছোটবেলা থেকে ছেলে পরিবারে নিজের গুরুত্ব বুঝতে পারে। আর মেয়ে বড় হয় অবদমিত মন নিয়ে।
অনেকের মতে, এখন পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে। কিছু পরিবার এখন ছেলেমেয়ের মধ্যে পার্থক্য করে না। তবুও বেশিরভাগ মানুষ এখনও ছেলে সন্তান হলেই বেশি খুশি হয়। মেয়ে সন্তানকে হয়ত সরাসরি অবহেলা করেন না লোকলজ্জায়। তখন তারা ছেলে হলে খুশি হয় কিন্তু মেয়ে হলে মেনে নেয়।
এই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক আবু সালেহ মো. সোয়াদ বলেন, ‘ছেলে হলে অধিকাংশ পরিবার বেশি খুশি হয়। অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও এই প্রবণতা আছে। এটা দৃষ্টিভঙ্গিগত ব্যাপার।’
তিনি আরও বলেন, ‘গর্ভবতী নারীর গর্ভে ছেলে সন্তান থাকলে ডাক্তার ও নার্স আল্টাসনোগ্রাম করানোর পর অত্যন্ত খুশি হয়ে সেই সংবাদটি রোগীর পরিবারের সদস্যদের জানায়। আর মেয়ে সন্তান গর্ভে থাকলে কিছু বলতে চান না। তার মানে, আমাদের দেশের ডাক্তার ও নার্স দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় এটা বোঝেন যে, ছেলে হওয়ার খবর দিলে মানুষ খুশি হয়। আর মেয়ে হওয়ার খবর জানালে গর্ভবতী মায়ের ওপর নানারকম নিপীড়ন হতে পারে।’
অর্থনৈতিক বিষয়
কমবেশি একটি চিন্তা অধিকাংশের মধ্যেই আছে- বৃদ্ধবয়সে বাবা মাকে দেখবে ছেলে। এজন্য ছেলে সন্তান বেশি কাঙ্খিত। এই চিন্তার প্রেক্ষিতে কিছু যুক্তি দাঁড় করানো যায়। যেমন
- সব ছেলেই কি বৃদ্ধ বয়সে বাবা মাকে দেখে? তাহলে দেশে এতোগুলো বৃদ্ধাশ্রমে কারা আসে?
- বাবা মায়ের দায়িত্ব ছেলে নিতে পারলে মেয়ে পারবে না কেন?
- মেয়েকেই কেন বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়?
- বিয়ের পর মেয়ে যদি শ্বশুর শ্বাশুড়ির দেখাশুনা করতে পারে তাহলে ছেলে কেন তার শ্বশুর শ্বাশুড়ির দায়িত্ব নিতে পারে না?
এরকম আরও বহু প্রশ্ন সামনে আসে। সমাজ যদি ছেলেমেয়েকে সমান দৃষ্টিতে দেখতো তবে মেয়েরাও বাবা মায়ের দায়িত্ব নিতে পারতো। সেই সংস্কৃতি নির্মিত হতো। আর এই সংস্কৃতি ছাড়া কখনও সংস্কার দূর হবে না।
আজও বদ্ধমূল একটি ধারণা আছে, অর্থনীতির সাথে যুক্ত কাজগুলো করবে ছেলে। মেয়ে মানেই শুধু ঘরের কাজ করবে। এজন্য বাবার সম্পত্তি আগলে রাখে ছেলে।
শাহনাজ পারভীনের তিন মেয়ে। স্বামী ব্যবসায়ী। বাড়ির বড় বৌ হিসেবে সংসারে তার দায়িত্ব বেশি। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িকে আপন করে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পারেননি। কারণ তিন মেয়ের মা হওয়ার কারণে ওই পরিবারে শাহনাজের কোন মূল্য নেই। তিনি বলেন, ‘স্বামী এমন আচরণ করে যে মেয়ে সন্তান হওয়ার জন্য শুধু আমি দায়ী। তার ব্যবসা কে দেখবে এই ভাবনা থেকেই আমাকে গালমন্দ করে।’
অনেকেই মনে করেন, বাবার কাজ কিংবা ব্যবসা দেখার জন্য ছেলে দরকার। মেয়েরা এসব পারে না। এক্ষেত্রে উধাহরণ হতে পারেন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। মেয়ে হয়েও বাবার উত্তরসূরি হয়েছেন তিনি।
ট্রান্সকম গ্রুপের কর্ণধার লতিফুর রহমানের মেয়ে সিমীন হোসেন। তিনি বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করছেন। ট্রান্সকমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসকেএফ ফার্মাসিটিক্যাল লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন সিমীন হোসেন।
এই উধাহরণগুলোর প্রেক্ষিতে অনেকেই মনে করতে পারেন- ‘এসব উচ্চবিত্তদের গল্প। সাধারণ মেয়েদের পক্ষে এতো স্মার্ট হওয়া সম্ভব না’। এই ধরনের ভাবনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, এখন প্রত্যেকটি কর্মক্ষেত্রে বিরাট অংশ জুড়ে মেয়ে। আগে মনে করা হত, মেয়েদের বুদ্ধি কম। বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে মেয়েরা অংশগ্রহণ করতে পারে না। এখন এই ধারণাও পাল্টে ফেলেছে মেয়েরা। নারী লেখক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানীর সংখ্যা কম না। খেলাধুলা, কৃষিকাজ, ভবন নির্মাণের মতো কঠিন কাজেও মেয়েদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। সুতরাং মেধা এবং শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছেলেদের প্রায় সমান।
আরেকটি কথা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। অনেকেই মনে করেন, ‘মেয়েদের শক্তি কম’। এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে সামাজিক দায় আছে। একটু বড় হলেই এদেশের অধিকাংশ পরিবারে মেয়েদের খেলাধুলা করতে দেওয়া হয় না। ভাল খাবারগুলো চলে যায় পুত্র সন্তানের পাতে। তাই মেয়েদের শারীরিক বিকাশও হয় না ঠিকমত। ফলে খুব কম মেয়েই সুঠাম দেহের অধিকারী হতে পারে। তবে উন্নত দেশে মেয়েরা অনেক খেলাধুলা ও শারীরিক পরিশ্রম করে। তাই তারা শারীরিকভাবে দুর্বল হয় না।
সামাজিক কারণ
মনে করা হয়, ছেলেরা হলো বংশের প্রদীপ। বংশের ধারক ও বাহক হলো পুরুষ। পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা পুরুষের হাতে থাকবে। বাবার ক্ষমতা যাবে ছেলের কাছে, ছেলের ক্ষমতা তার ছেলের কাছে। এইভাবেই সমাজের পতি থাকবে পুরুষরা। সমাজের প্রতিনিধি মেয়ে হতে পারে না। সামাজিক কিংবা পারিবারিক ক্ষেত্রে মেয়েদের মতামতের কোন মূল্য নেই। তাছাড়া সামাজিক কাজেও ছেলেরাই ভূমিকা পালন করে। এই ধরনের চিন্তা থেকেও ছেলে সন্তানের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সমাজে আরেকটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা হলো, ছেলেকে বিয়ে দিলে একটি বউ আসবে ঘরে। ছেলের বউ পরিবারের সবার দেখাশুনা করবে। সহজেই একটা কাজের মেয়ে পাওয়া যাবে (যদিও কাজের মেয়ে শব্দটি কোথাও সরাসরি ব্যবহার হয় না)। আর মেয়েকে তো পরের বাড়ি পাঠাতেই হবে। মেয়ের উপার্জন স্বামীর কাছে যাবে।
আবার অনেকেই মনে করেন, মেয়েরা সব ধরনের পেশায় যেতে পারেনা। ফলে বেশি টাকা উপার্জনের ক্ষমতা মেয়ের নেই। আর ছেলেরা সব ধরনের কাজ করতে পারে। ফলে ছেলেই বেশি টাকা আয় করতে পারে।
অনেকে ছেলের বিয়েতে মেয়ের বাড়ি থেকে প্রচুর জিনিস পাওয়ার আশা করে। মেয়ে বিয়ে দিলে নিজের টাকা খরচ হয় আর ছেলেকে বিয়ে দিলে অনেককিছু পাওয়া যায়।
সামাজিক এই সব ধ্যান-ধারণা ও রীতি-নীতির কারণেই ছেলে সন্তানকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে ছেলে সন্তানের প্রত্যাশা করা কোন বাবা মায়ের অপরাধ না। বরং সামাজিক প্রথা ও চিন্তাগুলোই মানুষের মধ্যে ছেলে সন্তানের চাহিদা বাড়িয়ে তুলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, ‘আমাদের সমাজে ছেলের মা হওয়া গৌরবের ব্যাপার হিসেবে মনে করা হয়। ছেলের মা হলে শ্বশুরবাড়িতেও নারীর অবস্থান ভাল হয়। তাছাড়া ছেলে থাকলে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে না, এটা ভেবে সন্তানের বাবাও খুশি থাকে।’
ধর্মে সম্পদের ভাগ
মুসলিম ধর্ম অনুযায়ী, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের অর্ধেক সম্পত্তি পায়। আর হিন্দুধর্মে মেয়েরা বাবার সম্পত্তি পায় না। তাই যে বাবার ছেলে সন্তান নেই তার সম্পত্তি ভাইয়ের ছেলে অর্থাৎ ভাতিজা পায়। এজন্য হিন্দুধর্মে অনেক নারীকে ছেলে সন্তান না হওয়া পর্যন্ত সন্তান নিতে বাধ্য করা হয়। সুতরাং দুটো ধর্মেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে ছেলেকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
সবক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে সমাজে নারীর অবস্থান অনেক নিচে, তাই নারী সন্তানও অনাকাঙ্খিত। এক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন আসছে কিনা জানতে চাইলে শিক্ষক আবু সালেহ মো. সোয়াদ বলেন, ‘ছেলে ও মেয়ে সন্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক ধারণা ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। যারা অনেক যত্ন নিয়ে মেয়েকে মানুষ করছে তারা ভাল ফল পাচ্ছে। মেয়েই বাবা মায়ের দায়িত্ব নিচ্ছে। তারপরও অনেকেই ভাবে, ছেলে হলেই ভাল হত। কারণ ছেলের সাথে অর্থ ভাবনা যুক্ত।’
বিগত বছরের একটি ঘটনা
গত বছর একটি ঘটনা সবার মনে আলোড়ন তোলে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক একজন নারী হাসপাতাল থেকে একটি ছেলে সন্তান চুরি করে। তার স্বামী একজন চিকিৎসক। উচ্চশিক্ষিত হওয়ার পরও কেন বাচ্চা চুরি করলেন, পুলিশের হাতে ধরা পড়লে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হন ওই নারী। তিনি তখন জানান, তার ছয় বছরের একটি কন্যা সন্তান আছে। প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ার কারণে শ্বশুরবাড়িতে তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। পরের সন্তান যদি আবারও মেয়ে হয় এই ভয়ে তিনি হাসপাতাল থেকে ছেলে বাচ্চা চুরি করেছেন।
একজন উচ্চশিক্ষিত নারী যখন ছেলে বাচ্চা চুরির মতো ঘটনার সাথে যুক্ত হয় তখন সহজেই বোঝা যায়, ছেলে সন্তান জন্ম দিতে না পারলে কত অপমান আর লাঞ্ছনা সইতে হয় এদেশের নারীর। তাছাড়া ওই নারীর স্বামী একজন চিকিৎসক। ছেলে বা মেয়ে হওয়ার জন্য নারী দায়ী নয়- তা বোঝার মতো শিক্ষা তার স্বামীর আছে। তবুও কেন তিনি স্ত্রীর পক্ষে দাঁড়ালেন না কিংবা স্ত্রীর কষ্ট বুঝলেন না?
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমুদিনী হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বিলকিস বেগম বলেন, ‘বংশ রক্ষার জন্য ছেলেই দরকার- এই ধরনের ভুল চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর এজন্য দরকার শিক্ষা। শুধু বইপুস্তক পড়ে বড় বড় ডিগ্রী অর্জনকেই প্রকৃত শিক্ষা বলে না। প্রকৃত শিক্ষা মানে মূল্যবোধ অর্জন করা। যারা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত তারা ছেলে ও মেয়ের মধ্যে ভেদাভেদ করে না। তারা ভাবে, আমার সন্তান সুস্থ আছে কিনা। তাছাড়া ছেলে কিংবা মেয়ে হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে পুরুষের ক্রোমোজোমের ওপর। এটা বুঝে প্রত্যেকের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা দরকার।’
বয়স্কদের মতে
সুলতানা জলি (৫৮) পেশায় একজন গৃহিনী। তার দুই নাতনী। দাদী হিসেবে তিনি একটি নাতী চান কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুই নাতনী হয়েছে বলে আমার কোন দুশ্চিন্তা নেই। কারণ আমি ছেলে ও মেয়ের মধ্যে পার্থক্য করিনা। ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই মানুষের মতো মানুষ করতে হয়। ছেলে যদি অমানুষ হয় তাহলে সেই ছেলে থেকে কি হবে? দ্বিতীয় মেয়েটার জন্মের পর অনেক আত্মীয়স্বজনকে বলতে শুনেছি ‘আহা! আবার মেয়ে হলো’। এই ধরনের কথাগুলোর প্রতিবাদও করেছি আমি।’
তবে সুলতানা জলির মতো মেয়ে সন্তানের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অনেকেরই থাকে না।
আরিফা হোসেনের বয়স ৬৬ বছর। তিন ছেলের মা তিনি। মেয়ে নেই বলে খুব দুঃখ করতেন একসময়। এমনকি ছোট ছেলের জন্মের পর কিছুদিন পর্যন্ত তাকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছাও নাকি হতো না তার। নিজের মেয়ে নেই বলে নাতনীর প্রত্যাশা করতেন বেশি। অথচ বড় ছেলের বৌয়ের প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ার পর হাসপাতালেই তিনি বলেন, ‘যতই হোক, প্রথম সন্তান ছেলে হওয়াই ভাল। তাতে ঝুঁকি থাকে না।’
ছেলে সন্তানের আশায় রোগীরা ডাক্তারের কাছে আসে কিনা জানতে চাইলে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী বলেন, ‘প্রথম বাচ্চাটি যদি মেয়ে হয় তাহলে দ্বিতীয়টি ছেলে হতেই হবে এমন মনোভাব নিয়ে অনেকেই আসেন। কী করলে ছেলে হবে এমন প্রশ্নও অনেকে করে থাকেন। আবার দুই তিনটি সন্তান যদি মেয়েই হয় তাহলে অনেক পরিবার ছেলেকে আবার বিয়ে দিতে চায়। তারা মনে করে, মেয়ে সন্তান জন্মের জন্য মা দায়ী, তাই আবার বিয়ে দিলে ছেলে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছেলের সেক্স ক্রোমেজোম X, Y আর মেয়ের X, X। সুতরাং মেয়ের মধ্যে একই ধরনের ক্রোমোজোম থাকে। স্বামীর X ক্রোমোজোম স্ত্রীর কাছে আসলে মেয়ে হয় আর Y ক্রোমোজোম আসলে ছেলে হয়। এই সহজ বিষয়টি সবার বোঝা দরকার।’
ইতিবাচক মনোভাব
আজকাল কেউ কেউ ছেলে ও মেয়ে সন্তানকে একইভাবে বড় করছেন। ছেলে, মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ দিচ্ছেন।
সাইফুল ইসলাম, পেশায় একজন ব্যাংকার। দুই মেয়ে তার। ছেলে সন্তানের প্রত্যাশা করেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ছেলে ও মেয়েকে আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করি না। বরং আমার সর্ব্বোচ্চটা দিয়ে দুই মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে চাই। মানুষ করতে চাই।’
রোদেলাও দুই মেয়ের মা। ছেলে সন্তান নেই বলে তার প্রতি শ্বশুরবাড়ির লোকজনের মনোভাব কেমন জানতে চেয়েছি গৃহিনী রোদেলার কাছে। তিনি বলেন, ‘আমার শ্বশুরবাড়ি হলো দেওয়ালে টাঙ্গানো সুন্দর একটি ছবির মতো। সুন্দর একটি ছবি দেখলে যেমন ভাল লাগে, তেমনি আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সাথে থাকতেও ভাল লাগে। আমার মেয়েদের প্রতি পরিবারের সবাই অনেক যত্নশীল। বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানো কিংবা গোলস করানো নিয়ে বেশিরভাগ দিনই আমাকে ভাবতে হয় না। তাছাড়া দুই মেয়ের জন্ম দিতে পেরেছি বলে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। কারণ অনেকের সন্তান হয় না। একটি বাচ্চার জন্য তারা কত হাহাকার করে। সেখানে আমার দুই মেয়ে আছে। তাই আমার মধ্যে কোন অভাববোধ নেই।’
অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, ছেলে সন্তান চাওয়ার পেছনেও কিছু কারণ রয়েছে। যেমন, আমাদের দেশে মেয়ের বিয়েতে প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়। অনেক বাবা মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। ফলে মেয়ে সন্তান অনেকের কাছেই বোঝা মনে হয়। তাছাড়া মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা নেই। ছেলে বাইরে গেলে বাবা মাকে বেশি চিন্তা করতে হয় না, কিন্তু মেয়ে বাইরে গেলে কিংবা বাসায় ফিরতে একটু রাত হলেই বাবা মায়ের চিন্তার সীমা থাকে না। নারী ধর্ষণ ও হয়রানি আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। তাছাড়া কোন মেয়ে ধর্ষিত হলে সমাজ ওই মেয়েটারই দোষ দেয়। অপরাধী পার পেয়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোন মেয়ের যদি বিয়ের পর সংসার ভেঙ্গে যায় তাহলে বাবার বাড়িতে সহজে ফিরে আসতে পারে না। আবার অন্য কাউকে বিয়ে করাও কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি এমন না। ছেলেরা সহজেই একাধিক মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। সমাজও এটা ইতিবাচকভাবে দেখে।’
ছেলে সন্তান প্রত্যাশার কারণটি এই সমাজের মধ্যেই নিহিত আছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, ‘এখন দম্পতিরা ছেলের আশায় অনেক সন্তান আর নেয় না। কারণ সন্তান নেওয়ার আগে অর্থনৈতিক দিকটি সবাই বিবেচনা করে। এই দিকটি কিছুটা পরিবর্তিত হলেও মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়নি। অর্থাৎ নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নারীকে গুরুত্ব দেওয়ার মনোভাব তৈরি হয়নি। এটাই বড় অসুবিধা। সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না হলে ছেলে ও মেয়ে সন্তান সম্পর্কিত ধারণাও পাল্টাবে না।’
সারাবাংলা/টিসি/ এসএস