আহা মন, আহারে মন
১৭ নভেম্বর ২০১৮ ২২:৩১
কিযী তাহনিন ।।
মরিচবাতি। মরিচবাতি যখন জ্বলে, তখন কি তা মিটিমিটি করে জ্বলে? নাকি স্থির থাকে। এই মুহূর্তে তিনি মনে করতে পারছেন না। মিটিমিটি, ধুকপুক, পিটপিট কোনো একটা ছন্দে বাতি জ্বলছে- কখনও চোখের পাপড়ি ফেলার সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে, কখনও হৃদস্পন্দনের ফাঁক ফোঁকরে ধুকপুক ছন্দে। মরিচবাতি জানান দেয়, ‘এই যে উৎসব আসছে।’
উৎসব তো একটা কোথাও দাঁড়িয়ে থাকা পথিক না। উৎসব হলো রূপ রস গন্ধের এক মিছিল। এই মুহূর্তে ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে যিনি মরিচবাতির ছন্দ নিয়ে আকাশকুসুম ভাবছিলেন, তার কাছে, উৎসব মানে বাবুর্চির আয়োজন করা কাঠচুলার কোলে বসা ইয়া বড় লোহার পেটমোটা ডেকচি থেকে ভেসে আসা ঘি আর গোলাপজলে মাখা পোলাওয়ের সুবাস। তীব্র আর স্নিগ্ধ পারফিউমেরে ঝাপ্টা ঝাপ্টা সুগন্ধি বাতাস, আর মরিচবাতির খেলা- আলোর খেলা।
-কিযী’র জানালা থেকে: শুনতে চাইলে ক্লিক করুন-
গতকাল ছিল হলুদ, আগামীকাল বিয়ে। আজ ফাঁকা। কাজ নেই। এটি কনের বাড়ি। জেনে আসা নিয়ম মেনে, কনের বাড়িতে করুণ সুর খানিকটা থাকে থাকুক, কিন্তু তাকে উপচে যে উৎসবের সুর, তা উপেক্ষা করবে কে? বাড়িভর্তি মানুষ, ডালা কুলো ফুল পাখি আলোর খেলায়, লাল বেনারসির সাথে নীল জারদৌসি কাজের ব্লাউজ, সবুজ পাঞ্জাবির সাথে ব্রোকেটের কটি, হাজারো কাজ।
এ আনন্দরাগের আসরে চিরাচরিত নিয়মে আজ তারও কি উপস্থিত থাকবার কথা নয়? তার পুতুল পুতুল মেয়েটার কাল বিয়ে। এ বাড়ি জুড়ে উৎসব। নিজ জায়গায় থেকে ঠিকঠাক সব দায়িত্ব পালন করেছেন, যা যা করতে হয় মা হিসেবে। কিন্তু এ উৎসবকে উপভোগ করবার জন্য যে সক্ষমতা দরকার, এই মুহূর্তে তা তার নেই। তিনি সব কিছুতেই উপস্থিত আছেন, কিন্তু তিনি যে আসলে কোথাও নেই, কেউ কি তা বুঝছে? না বোধ হয়, তিনি কাউকে বুঝতে দিচ্ছেন না। কিন্তু তিনি তার সবটুকু বোধ দিয়ে বুঝছেন, তিনি ভালো নেই।
তার যে অসুখ। তিনি ভালো নেই। অনেকদিন হলো। তিনি এমন এক অসুখে আক্রান্ত, যা বলবার চেয়ে না বলাতেই স্বস্তি বেশি। শরীরে জ্বর, কাশি, টাইফয়েড- প্যারাসিটামল, ঠাণ্ডার ওষুধ, টুশকা, অ্যান্টিবায়োটিক, স্যালাইন, কি গর্বের সাথে সবাইকে বলা যায়, শরীরটা খারাপ ছিল।
কিন্তু মন? আকারহীন মন, তার অসুখ কোথায়? জ্বর নাকি কাশি? সর্দি নাকি পেট ব্যথা? মনের তো এসব নেই। মনের আবার অসুখ কি? মনের অসুখ বলে কিছু হয় নাকি? সব মনে মনে পাগলামি।
মনের অসুখ হলে কেমন করে সারাতে হয় তিনি তো জানেন না। অথবা না জানাটাই শ্রেয়? দ্বন্দ্ব তো নিজের সাথে। ‘মানুষ কি ভাববে’ তো এক বাহানা মাত্র। শরীর তো ছোঁয়া যায়- এই যে নাক, কান, গলা, পেট, চোখ, হাত পা পিঠ। মন এমন বিদঘুটে তাকে ছোঁয়া যায় না, ধরা যায় না, মাফলার দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা যায় না। মনের জ্বরে জলপট্টি তো আর দেয়া যায় না।
তবু কোত্থেকে মনের অসুখ হয়? অবসাদ হয়? কোথায় তার বাস?
তাই সন্ধ্যা শেষের, মরিচবাতির উৎসবে, সবার থেকে আড়াল হয়ে, তিনি নিজের মুখোমুখি।
যাবো?
– যাও।
বাপরে, মেয়ের বিয়ে। ছেলেপক্ষ যদি জানে মেয়ের মায়ের মনের অসুখ? ডিপ্রেশন। কাউন্সিলরের কাছে যাবেন। জানলে বিয়ে ভেঙে যাবে না?
কেন? মনটা খারাপ, ডিপ্রেসড লাগে, মনটা ভীষণ ক্লান্ত। এটা মানুষ জানলে মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাবে?
দিতে পারে।
ডায়াবেটিস, হাই কোলেস্টরেল, হাই প্রেসার? এই অসুখেও কি মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাবে?
না তা কেন ঐগুলা তো অসুখ?
আর মনের অবসাদ, ক্লান্তি? অসুখ নয়? শরীরের জ্বর হয়, মনের হয় না। কিন্তু মন ১০৫ ডিগ্রি তাপে পোড়ে না কখনো? মনের ঠাণ্ডা সর্দি হয় না। তবুও শীতল অনুভূতিতে মন কেমন কেমন করে কেঁপে ওঠে না?
তিনি ভাবছেন। আর সবাই যেমন করে ভাবে। যেমন করে ভাবতে যায়। এটি একটি তথাকথিত ‘লোকে কি বলবে’র জালে আটকে যাওয়া, হেরে যাওয়ার গল্প’ ভেবেছিলাম। যতদিন পর্যন্ত ‘শরীরের অসুখের’ নাম দিয়ে মনের অসুখকে আটকে রাখা যায়, এমন একটি গল্প ভেবেছিলাম। মনের দেয়াল অসুস্থ হয়ে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ার আগে পর্যন্ত সস্তা রঙে তাকে আটকে রাখার, আরেকটি ‘মনের অসুখকে শরীরের অসুখ’ বলে চালিয়ে দেবার ব্যর্থতার গল্প ভেবেছিলাম। এবং ভেবেই জানালাটা যখন আটকে দিবো ভাবলাম, দেখি, নাহ, মরিচবাতির উৎসব মিছিলে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি, মন সারাইয়ের ঘর খুঁজে পেয়েছেন। ফিসফিস, আস্তে আস্তে এবং প্রত্যয়ের সাথে তিনি যে বলছেন, আমি তা শুনছি, “হ্যাঁ আমার মনের অসুখ হয়েছে, শরীরের যেমন হয়। আমার মনের চিকিৎসা-শুশ্রুষা প্রয়োজন। শরীরের যেমন প্রয়োজন।”
আর আমার মন দেখি ফুরফুরে মেজাজে গুনগুন করে সুর ভাজছে- আহা মন, আহারে মন। আমি জানালাটা আরও বড় করে খুলে দিলাম।