‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৩
৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ১২:০৫
।। ফারুক ওয়াহিদ ।।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ দিনটি ছিল শুক্রবার। শুক্রবারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সুখবর ছিল বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড গঠন করা—তাতে রণাঙ্গনে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধারা। মিত্রবাহিনী আর বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিত প্রতিরোধের মুখে পরাজিত হতে থাকে পাকিস্তানি হানাদাররা। অসীম সাহসী মুক্তিবাহিনী শক্ত মনোবল আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিজয় অর্জনের পথে সব বাধা অতিক্রম করে এগোতে থাকেন দুর্দমনীয় গতিতে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা হয়ে গেলাম বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড-এর অধীন—অর্থাৎ ভারতীয় সেনাবাহিনী সৈন্য বাহিনী হয়ে গেল আমাদের মিত্রবাহিনী। ‘মিত্রবাহিনী’ শব্দটি স্কুলে ২য় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস পড়তে গিয়ে পরিচিত হয়েছিলাম—একাত্তরে আবার নতুন ‘মিত্রবাহিনী’র সঙ্গে পরিচয় হলো, যারা ছিলেন আমাদের সহযোদ্ধা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর এই ঐতিহাসিক মৈত্রীর কাহিনী—মহান শিল্পী ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে বাংলা ও অহমিয়া ভাষায় ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে রয়েছে- ‘জয় জয় মুক্তিবাহিনী/ ভারতীয় সৈন্যের সাথে রচিলে/ মৈত্রীর কাহিনী।’
‘জয় জয় নবজাত বাংলাদেশ/জয় জয় মুক্তিবাহিনী/জয় জয় নবজাত বাংলাদেশ/জয় জয় মুক্তিবাহিনী/ ভারতীয় সৈন্যের সাথে রচিলে/মৈত্রীর কাহিনী।।/ধর্মান্ধতার বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতা/বিভেদগামী শক্তির বদলে/গঙ্গা পদ্মার একতা/বিশাল ভলগা, গঙ্গা-পদ্মার/ পাড় ভেঙ্গে এক হল পানি।।/সামন্ততন্ত্রের বিপরীতে, এক নতুন প্রজাতন্ত্র/সমরতন্ত্রের বিপরীতে/এক অভিনব সমাজতন্ত্র/স্থাপনা করে রক্তে লিখিলে/শেখ মুজিবরের বাণী।।
যৌথ বাহিনী ঘোষণার পর মুক্তিপাগল বীর মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ ছেড়ে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে যৌথভাবে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এতোদিন সীমান্তে প্রকাশ্যে ঘোষণা ছাড়া অন্তরালে মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিল—আর আজ থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একাকার হয়ে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে—মিত্র-মুক্তিবাহিনীর রক্তে সিক্ত হয়ে যায় বাংলার পবিত্র মাটি, বিশ্বের ইতিহাসে এরকম ঘটনা খুবই বিরল—এ যেন ‘স্থাপনা করে রক্তে লিখিলে/শেখ মুজিবরের বাণী।।’
এদিকে এদিন অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর কুমিল্লায় ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী কুমিল্লার মিয়াবাজারে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মিয়াবাজার দখল করে নেন। এই ক্যাপ্টেন আয়েনউদ্দিন আমাদের বাঞ্ছারামপুরের ৫০ জনের একটি গেরিলা গ্রুপকে আগরতলার মনতলা ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন এবং এই গেরিলা গ্রুপে আমি নিজেও ছিলাম এবং এই ৫০ জন গ্রুপের ৫ জন শহীদ হয়েছিলেন এবং প্রায় সবাই কম-বেশি আহত হয়েছিলাম।
একাত্তরের এই দিনে মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী নোয়াখালীর মাইজদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মুক্ত করে সোনাইমুড়ী—এরপর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চৌমুহনীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর দুর্বার আক্রমণ শুরু করে। এদিকে আখাউড়া সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে চলছে বিরতিহীন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সাতক্ষীরা সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকিস্তানিরা পিছু হটে দৌলতপুরের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। রংপুরের পলাশবাড়িতে পরাজিত হয় পাকিস্তান সেনারা এবং সেখানে কিছু সৈন্য মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় মিত্রবাহিনীর নবম ডিভিশন যশোর ঢাকা মহাসড়কসহ চতুর্থ ডিভিশন ষষ্ঠ ডিভিশনের বেশ কয়েকটি এলাকায় যোগাযোগ পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর জেলার আরও কয়েকটি থানা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সমস্ত পাক অধিকৃত বন্দর অবরোধ করে জলপথে সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। আক্রমণের প্রথমেই হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর সাবমেরিন ‘গাজী’কে মিত্রবাহিনী বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয়। পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে সব ফ্লাইট বাতিল করে। সামরিক কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি ও নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা পালনের নির্দেশ দেয়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে বরগুনা শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বরগুনার বিভিন্ন জায়গায় পাক হানাদার বাহিনী পৈশাচিক নারী নির্যাতন ও নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠতে না পেড়ে পাকিস্তান বাহিনী দেশের বিভিন্নস্থানে হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, নির্যাতন আরও বাড়িয়ে দেয়।
৩ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে বলেন, ‘বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী যে অত্যাচার করেছে, শরণার্থীরা কেন ভারতে আসছে তার কারণ অনুসন্ধান কেউ করেনি, করতে চায়নি, বিদেশের কাছে বারে বারে সব বলা হয়েছে—কিন্তু তারা কেউ এগিয়ে আসেনি। আমরা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এভাবে মরতে দিতে পারি না, আমরা মরতে দেবো না, ভারতের পঞ্চান্ন কোটি মানুষের পূর্ণ সাহায্য বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে থাকবে।’ এদিকে সমাবেশ চলাকালীন অবস্থায় মঞ্চের মধ্যেই জরুরি খবরে আসে পাকিস্তান বিনা উসকানিতে যুদ্ধ ঘোষণা করে ভারত আক্রমণ করেছে। ইন্দিরা গান্ধী বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে রাজধানী নয়াদিল্লীতে চলে আসেন এবং ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় দিবাগত রাত বারোটা কুড়ি মিনিটে জাতীর উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণ দেন এবং দেশব্যাপী ঐক্য ও ত্যাগ স্বীকারের জন্য আহ্বান জানান এবং প্রতিটি নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আজকের এই গভীর জাতীয় সংকটের দিনে অবস্থার মোকাবেলার জন্য আহ্বান জানান। সারা ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।
জাতির উদ্দেশে ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আরও বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ মোকাবিলায় দেশকে তৈরি করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।’ এই ঘোষণার পরপরই ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডের লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের ভারত যৌথ কমান্ড। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড দুর্বার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল হানাদার বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের ইতিহাস শুরু হয় এদিন থেকেই। গভীর রাতে পূর্ণাঙ্গ লড়াই শুরু হয়। চতুর্দিক থেকে বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করল ভারতীয় সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনী- আর মুক্ত এলাকা থেকে যোগ দিল বীরের বেশে মুক্তিযোদ্ধারা।
এই দিন তৎকালীন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা দেয়—বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে যেকোনো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তারা ভেটো দিবে।
লেখক: ফারুক ওয়াহিদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা; ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
অারও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’ ডিসেম্বর ২