‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৫
৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৮:৩৯
।।ফারুক ওয়াহিদ।।
৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ হেমন্তের শীতার্ত বিজয়ের আরেকটি উজ্জ্বল দিন- দিনটি ছিল রবিবার। ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ এই দিনে বাংলার নীল আকাশ সম্পূর্ণ হানাদার মুক্ত হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের আকাশে আকাশে বাংলাদেশ ও মিত্র তথা যৌথবাহিনীর সাথে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রচন্ড লড়াই হয়- মিত্রবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলো সারাদিন ধরে অবাধে বাংলার মুক্ত আকাশে উড়ে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে প্রচন্ড আক্রমণ চালায় এবং অকেজো করে দেয় বিমানবন্দরগুলো- পাকিস্তান বিমানবাহিনীর শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। মুখ থুবরে পড়ে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমান- দুপুরের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয় হানাদার পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রায় সব বিমান- মুক্তি-মিত্রবাহিনীর বিমানবাহিনী ঢাকার আকাশ পুরোপুরি দখল করে নেয়। চারদিকে বিজয়ের রণধ্বনী। অবরুদ্ধ ঢাকাবাসী বাসা-বাড়ির ছাদে উঠে প্রকাশ্য দিবালোকে এই বিমান যুদ্ধ দেখে এবং পাকিস্তানি বিমানের পতন দেখে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে- পৃথিবীর বিমান যুদ্ধের ইতিহাসে এরকম ঘটনা এই প্রথম- কারন বিমান আক্রমনের সময় সাধারণত বেসামরিক জনগন ট্রেঞ্চ বা পরিখায় প্রবেশ করে আশ্রয় নেয়- আর আজ বিজয়ের আনন্দে ঢাকার মানুষ বাড়ির ছাদে উঠে বিমান যুদ্ধ দেখছে।
মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণে হনাদার পাকিস্তানিদের ঢাকার সুরক্ষিত কুর্মিটোলা বিমানবন্দর অকেজো হয়ে পড়ে। একটি হাজার পাউন্ড বোমার আঘাতে বিমানবন্দরে ২০ ফুট ব্যাসের একটি বড় গর্ত সৃষ্টি হয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিছু হঠে পালাতে থাকে। বিজয়ের বেশে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী। সাড়ে সাত কোটি মানুষ মহান বিজয়েরে অপেক্ষার প্রহর গনতে থাকে।
আখাউড়ায় প্রচন্ড সংঘর্ষের পর হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পতন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার- মুক্তির প্রতীক্ষায় ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী। এদিকে আখাউড়ায় চলছে বিজয় উল্লাস- পাকিস্তানিদের বড় শক্ত ঘাঁটি আখাউড়া মুক্ত হওয়ার পর মানুষ জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে আনন্দ ও বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে। আখাউড়ার যুদ্ধে মিত্রবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ নং ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক লে. কর্ণেল বেগ সহ ৬ জন সেনাবাহিনীর অফিসার, ৮ জন জুনিয়ার কমিশনড অফিসার ও একশ আর্মি ও প্যারা মিলিটারির ফোর্সের ১৩৫জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এখানে মিত্র-মুক্তিবাহিনী দুইটি পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক ও প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে।
পাকিস্তানিরা আত্মরক্ষার্থে শহরে এসে সমবেত হতে থাকে এবং এ সময় তারা রাস্তার দুইপাশের জনবসতিতে অগ্নিসংযোগ, নির্বিচারে মানুষ হত্যা ও লুটপাটে লিপ্ত হয়। এদিকে দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ এলাকায় অগ্রসরমান মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং মুক্ত এলাকায় মুজিবনগর সরকারের প্রশাসন চালু করা হয়। সেক্টর কমান্ডাররাও একে একে নিজেদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার স্থানান্তর শুরু করেন মুক্তাঞ্চলে।
ঢাকার আশপাশে গেরিলা বাহিনীর সম্মুখ আক্রমণে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী পরাজয়ের দিন গুনতে শুরু করে। সম্মুখযুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধেও হারতে থাকে পাকিস্তান। এ সময় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চোখে রাজনীতির এক নতুন প্রেক্ষাপট হয়ে ওঠে যুদ্ধরত বাংলাদেশ।
ডিসেম্বরের এদিনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের খুশি করতে পূর্বাঞ্চলের রাজনীতিক নূরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমাঞ্চলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উপ-প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয় না। বাংলার মানুষ তখন অপেক্ষায়, কবে আসবে মহামুক্তির দিন।
বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল লড়াইটা ছিল দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আর যুক্তরাষ্ট্র সরকার ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। আর বাংলাদেশ সম্পর্কে পরিষদে তৃতীয় প্রস্তাবটি পেশ করে বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপান। এদিকে জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধিরা বলেন, কোনো শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এ উত্তপ্ত অবস্থাতে যাতে মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারিয়ে না ফেলেন সেজন্য মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতারে ভাষণ দেন।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশ বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। এছাড়া ভারত ও রাশিয়া বাঙালি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বপ্রকার সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। ফলে চূড়ান্ত বিজয়ের পথে বাঙালি মুক্তি সেনারা এগিয়ে চলে।
বখশীগঞ্জে যৌথ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। মুক্ত হয় পীরগঞ্জ, হাতিবান্ধা, পঞ্চগড়, বোদা, ফুলবাড়ী, বীরগঞ্জ ও নবাবগঞ্জ। আর জীবননগর, দর্শনা ও কোট চাঁদপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে।
এদিন চট্টগ্রামে পাকিস্তান নৌবাহিনী ও যৌথ নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলোর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডার চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে সকল বিদেশি জাহাজগুলোকে বন্দরে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বিদেশি জাহাজগুলো এই সময় নিরাপত্তা চাইলে যৌথ কমান্ডার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। পৃথিবীর সব দেশ তখন বুঝতে পারে যে শীঘ্রই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটতে যাচ্ছে। এই দিন লেফটন্যান্ট আরেফিনের নেতৃত্বে চালনা নৌবন্দরে এক তীব্র আক্রমণ সংঘটিত হয়। মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণের ফলে পাকিস্তান বাহিনীর সব সৈন্য বন্দর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। বিশ্বের সব দেশ বুঝতে পারে বাংলাদেশের বন্দরগুলো রক্ষা করার ক্ষমতা আর পাকিস্তানি বাহিনীর নেই।
পাকিস্তান রক্ষায় বঙ্গোপসাগরে কেউ কোনো নৌ জাহাজ পাঠালে তারাও ভারতের আক্রমণের শিকার হতে পারে- এই বলে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এদিকে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর প্রতি সোভিয়েট ইউনিয়ন এই বলে সতর্কবাণী দেয়- ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ থেকে নিজেদের দূরে রাখুন।’ বিবৃতিতে পাকিস্তানকে আগুন নিয়ে খেলার পরিণতি সম্পর্কে সজাক থাকতে রুশ সরকার আহ্বান জানান।
১৯৭১ এর এই দিনে আখাউড়া সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। মিত্রবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক অবরোধ করে ফেলে। এর ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে। মিত্র-মুক্তিবাহিনী লাকসাম রেলওয়ে জংশন দখল করে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। চৌদ্দগ্রাম, চৌয়ারা, সুলতানপুর মুক্তিবাহিনী মুক্ত করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানিদের সাথে মিত্র-মুক্তিবাহিনীর মরনপণ প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে। সুলতানপুর ছিল পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি এবং এই সুলতানপুরে আমার(লেখকের) গ্রুপের অর্থাৎ বাঞ্ছারামপুরের ৫০ জনের গেরিলা দলটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাতা এ্যামবুসে পড়ে যায় এবং সংঘর্ষে বাঞ্ছারামপুরের ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন।
একাত্তরের এই দিনে মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট স্থলপথে এগিয়ে আসতে থাকে। মিত্র বাহিনীর স্থল, বিমান ও নৌ-বহরকে বাংলাদেশের সাধারণ জনগন অভিনন্দন জানিয়ে স্থানীয়ভাবে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। প্রধান সড়ক দিয়ে না এগিয়েও মিত্রবাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কের কতোগুলো এলাকায় অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের, নাটোরের সঙ্গে ঢাকা ও রংপুরের এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। এখানে পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকতে না পেরে অবশেষে আত্মসমর্পণ করে। ফলে আখাউড়া সম্পূর্ণরূপে শত্রু মুক্ত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহী আমীর হোসেন, লেফট্যানেন্ট বদিউজ্জামান, সিপাহী রুহুল আমীন, সিপাহী সাহাব উদ্দীন, সিপাহী মুস্তাফিজুর রহমান শহিদ হন। আখাউড়া মুক্ত হওয়ার পর কিছু পাকিস্তানি সৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পালিয়ে যাওয়ার সময় মিত্রবাহিনীর হাতে নিহত হয়।
চারিদিকে এসব বিজয়ের সংবাদে রণাঙ্গনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের আরো উৎসাহ দেওয়ার জন্য স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের রণসঙ্গীত অনবরত বাজতে থাকে- “মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম/ মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল,/ মোরা বিধাতার মত নির্ভয়/ মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।।/ মোরা আকাশের মত বাঁধাহীন/ মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন,/ বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন/চিত্তমুক্ত শতদল।।
https://www.youtube.com/watch?v=A_CCdZitx8I&feature=youtu.be
/ মোরা সিন্ধু জোঁয়ার কলকল/ মোরা পাগলা জোঁয়ার ঝরঝর।/ কল-কল-কল, ছল-ছল-ছল/ মোরা দিল খোলা খোলা প্রান্তর,/ মোরা শক্তি অটল মহীধর।/ হাসি গান শ্যাম উচ্ছল/ বৃষ্টির জল বনফল খাই-/ শয্যা শ্যামল বনতল।”
-রণাঙ্গনে থাকা অবস্থায় সেই গান শোনে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরে শিহরণ জেগে উঠে এবং রক্ত টগবগ করতে থাকে- আমাদের মনের অবস্থা সেই মুহূর্তে কেমন ছিল আসলে সেটা বুঝানো যাবেনা- কেউ বুঝবেও না- আমরা অতি উৎসাহিত হয়ে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়ি হানাদার বর্বর পাকিস্তানিদের উপর।
লেখক: ফারুক ওয়াহিদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা; ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৪