‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৭
৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৮:২৯
।। ফারুক ওয়াহিদ ।।
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, মঙ্গলবার। এদিন হেমন্তের সূর্যোদয়ের পর সকালটা শুরু হয় বাংলাদেশের নতুন পরিচয় দিয়ে— বাংলাদেশ এখন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। এরই মধ্যে ভুটান স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এদিকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে লেখা হয় ‘স্বীকৃতির তিলক বাংলাদেশের ললাটে। বাংলাদেশের আজ বিচলিত হওয়ার কিছু নাই। সূর্যোদয়কে যাহারা অস্বীকার করে, তাহারা অন্ধ মাত্র, অস্বীকৃতির দৃষ্টিহীনতা সকালের রশ্মিজলকে মিথ্যা করিয়া দিতে পারে না।’ বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এক যুক্ত তারবার্তায় বলেন, ‘ভারত সরকার বাংলাদেশের মানুষের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম ও গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্তে আমাদের আবেগাপ্লুত চিত্তের অভিনন্দন গ্রহণ করুন।’
আরও পড়ুন- ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৬
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যশোরের সর্বত্র উত্তোলিত করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এদিন ভারতীয় বেতার কেন্দ্র আকাশবাণী থেকে রাত ১০টায় হিন্দি, উর্দু ও পশতু ভাষায় ভারতের সেনাধ্যক্ষ জেনারেল মানেকশ’ বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তোমাদের বাঁচার কোনো পথ নেই। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য তোমাদের ঘিরে রেখেছে। তোমরা যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছ, তারা তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। অনেক দেরি হওয়ার আগেই তোমরা আত্মসমর্পণ কর।’ রণাঙ্গনে বিজয়ের বেশে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের আরও উৎসাহ দেওয়ার জন্য-স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত দেশাত্মবোধক ও যুদ্ধের গান বাজতে থাকে…
‘দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!/দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ/ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ/কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত/এ তুফান ভারি, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!/তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!/যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান/ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,/ ইহাদের পথে, নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার!!/অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,/ কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!/হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!/গিরি-সংকট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ,/পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!/কাণ্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?/করে হানাহানি, তবু চল টানি, নিয়াছ যে মহাভার!/কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,/বাঙালির খুনে লাল হলো যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!/ ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!/উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।/ফাঁসির মঞ্চে যারা গেয়ে গেল জীবনের জয়গান,/আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান/আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান?/দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কাণ্ডারী হুঁশিয়ার!।।’ (‘কাণ্ডারী হুশিয়ার!’—কাজী নজরুল ইসলাম—‘সর্বহারা’)
আরও পড়ুন- ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৫
সাড়ে সাত কোটি বাঙালি স্বাধীনতার রাঙাপ্রভাতকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এদিকে যুদ্ধ পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে জেনারেল নিয়াজি গোপন বার্তা পাঠিয়েছিলেন রাওয়ালপিন্ডি হেড কোয়ার্টারে। রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেন, ‘সৈন্যরা দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লাকসাম, চাঁদপুর ও যশোরে প্রবল চাপের মুখে রয়েছে। গত ১৭ দিনে যেসব খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে, তাতে জনবল ও সম্পদের বিচারে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে গেছে। রাজাকারদের অস্ত্রসহ শটকে পড়ার সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের নিজেদের ট্যাংক, ভারি কামান ও বিমান সমর্থন না থাকায় পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটেছে।’ এ বার্তা পেয়ে হেড কোয়ার্টার থেকে সম্মুখ সমরের সৈন্যদের পিছিয়ে এনে প্রতিরোধ ঘাঁটিতে সমবেত করার পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়।
আরও পড়ুন- ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৪
আজ ৭ ডিসেম্বর রণাঙ্গনের সর্বশেষ অবস্থা হলো—মিত্র-মুক্তিবাহিনীর দুর্বার অভিযানের কাছে বর্বর পাকিস্তানি সেনারা পরাস্ত, হতাহত, বন্দী অথবা পলায়নপর অবস্থা। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট মিত্র-মুক্তিবাহিনী চারদিক দিয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছে—পালাবার কোনো পথ নেই, হয় আত্মসমর্পণ করতে হবে না হয় মৃত্যু। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি—এখানে নয় মাসই প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছে, সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া মিত্র-মুক্তিবাহিনী অবরুদ্ধ করে রেখেছে—ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থাও হয় আত্মসমর্পণ না হয় মৃত্যু—হয়তো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিকামী মানুষ আগামীকাল মুক্তির রাঙাপ্রভাত দেখতে পাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি মিত্র-মুক্তিবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ যে কোনো সময় পতন। সিলেট মুক্ত সেখানে বিমানবন্দরে মিত্র বাহিনীর হেলিকপ্টারও বিনাবাধায় অবতরণ করেছে। লালমণিরহাট মুক্ত।
আরও পড়ুন- ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৩
এদিকে বাংলাদেশের পতাকা খচিত মুক্তিবাহিনীর বিমান বাহিনী ৬ ডিসেম্বর থেকেই পুরোদমে পাকিস্তানি শক্ত ঘাঁটির ওপর আঘাত অব্যাহত রেখেছে। গতকালই মুক্তিবাহিনীর বিমান সিলেট রণাঙ্গনে চারটি মালবাহী ট্রেনের ওপর সফল আঘাত হানেন। বাংলাদেশের স্বর্ণালি মানচিত্র খচিত লাল-সবুজ পতাকাবাহী জঙ্গি বিমান দেখে হানাদার পাকিস্তানিরাও হতবাক ও স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছে—আর মুক্তিবাহিনী ও জনতা বাংলাদেশের পতাকাবাহী জঙ্গি বিমান দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ছে। এদিকে জাতিসংঘের কর্মীদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য কয়েকটি বিমান গতকালের মতো আজও ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করতে না পেরে হংকং ফিরে যায়।
আরও পড়ুন- ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ২
লেখক: ফারুক ওয়াহিদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা; ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।