‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১০
১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৯:১৯
।।ফারুক ওয়াহিদ ।।
১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয়ের দিনটি ছিল শুক্রবার। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী পালানোর আগে নতুন করে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। বেশির ভাগ জেলা, মহকুমা শহর ও থানা মিত্র-মুক্তিবাহিনী মুক্ত করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। মিত্র-মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের উপর যৌথভাবে চূড়ান্ত হামলার উদ্দেশ্যে মিত্রবাহিনী একের পর এক বাধা পেরিয়ে বিজয়ের বেশে ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে এবং এরই মধ্যে ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে। মিত্রবাহিনী বোমা বর্ষণ করে বিধ্বস্ত করে দেয় ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দর। ঢাকায় চলছে কারফিউ ও ব্ল্যাকআউট রাতে ঢাকা শহর হয়ে যায় ভূতুরে শহর। যুদ্ধে পরাজয়ের আশঙ্কায় লে. জেনারেল নিয়াজী পালাবার পাঁয়তারা করে- তার এই গোপন অভিসন্ধি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি ফাঁস করে দেয়। জে. নিয়াজি তার দুর্বলতা ঢাকার জন্য ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বিদেশি সাংবাদিকর উদ্দেশ্যে দম্ভভরে বলেন, “আমি কখনো আমার সেনাবাহিনীকে ছেড়ে যাব না।”
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৯
ময়মনসিংহ শহরে এদিন পাকিস্তান সেনারা অনেক নিরীহ মানুষ হত্যা করে। বিভিন্ন জায়গা থেকে পিছু হঠতে হঠতে পাকিস্তানিরা ময়মনসিংহ শহরে এসে জড়ো হয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যাতে দ্রুত ময়মনসিংহ শহরের দিকে না আসতে পারে, সেজন্য ময়মনসিংহ-হালুয়াঘাট সড়কের বিভিন্ন স্থানে মাইন পুঁতে রেখে আসে। ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পাড়ে শম্ভুগঞ্জে এসে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী শক্ত অবস্থান নেয়। আতঙ্কিত হয়ে পাকিস্তানি সেনারা ৯ ডিসেম্বর রাতেই ময়মনসিংহ শহর ছেড়ে সড়কপথে টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার দিকে পালাতে থাকে এবং পালানোর আগে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর রেলওয়ে ব্রিজটি তারা ধ্বংস করে দেয়- যাতে মিত্র-মুক্তিবাহিনী তাদেরকে দ্রুত আক্রমণ বা ধরতে না পারে। জামালপুর-এর পাকিস্তানি সেনারা অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে।
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৮
এদিকে ঢাকার দিকে পালানোর সময় হানাদার পাকিস্তানিরা ভৈরব ব্রিজের একটি স্পেন ধ্বংস করে দিলেও হেলিকাপ্টার ও স্টিমার ও দেশি নৌকাযোগে মেঘনা নদী পার হয়ে মিত্রবাহিনী ভৈরববাজারে উপস্থিত হয়ে ঢাকার দিকে এগোতে থাকে। মিত্রবাহিনী আশুগঞ্জ-ভৈরববাজারের মেঘনা নদী অতিক্রম করার সময় সাধারণ জনগণ দেশি নৌকা যোগে নদী পার হতে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করে। এদিকে বাইরে থেকে পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী যাতে ঢাকায় ঢুকতে না পারে সেজন্য নদীপথে তাদের যতগুলো স্টিমার-গানবোট এগোনোর চেষ্টা করেছিল মিত্র বাহিনীর বিমান হামলায় বোমা বর্ষণ করে সেগুলোকে ডুবিয়ে দেয়।
অন্যদিকে মিত্র বাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে। কয়েকটা জাহাজ ভর্তি পলায়নপর পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গোপসাগর দিয়ে পালানোর সময় মিত্রবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। এদিকে উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধে মিত্র ও মুক্তি বাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরের পাকিস্তানি বাহিনীকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঘেরাও করে ফেলে। গাইবান্ধায় তখনও প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে। মঙ্গলা বন্দর মিত্র-মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। যশোরের পলাতক পাকিস্তানি সেনারা খুলনায় জমায়েত হয়েছে।
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৭
জলে-স্থলে অন্তরীক্ষে পাকিস্তানি বাহিনী মিত্র ও মুক্তিবাহিনী কতৃক আক্রান্ত এবং পালাবার পথও বন্ধ। এদিকে আত্মসমর্পণ না করলে ঢাকার উপর প্রচন্ডতম আঘাত হানবে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী। ঢাকার অসামরিক জনগণ সুযোগ পেলেই ঢাকা থেকে সরে যাচ্ছে। ঢাকায় খাদ্য ও পণ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ঢাকার অবরুদ্ধ মানুষ মুক্তির আনন্দে উৎফুল্ল- অন্যদিকে মৃত্যুর শঙ্কায় শঙ্কিত। ঢাকার অবরুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র সম্বরণের জন্য নির্দেশ দিয়ে সময় বেধে দেয়া হচ্ছে। এদিকে নোয়াখালী মুক্তিবাহিনী মুক্ত করে নেয়। মিত্রবাহিনীর নৌবাহিনী কতৃক চট্টগাম অস্ত্র নির্মাণ কারখানা আক্রান্ত হয়। মুক্তি-মিত্রবাহিনীর বিমান পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যদের দুটি বড় স্টিমারের উপর বোমাবর্ষণ করে একটি জ্বালিয়ে দেয় এবং অন্যটিকে ডুবিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৬
মুক্তাঞ্চলগুলোতে প্রাণের স্পন্দন ফিরে আসছে। এদিকে ১০ ডিসেম্বর শুক্রবারও মুক্ত এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখনও মনে হচ্ছে বোবা আতঙ্কিত যুদ্ধ-বিধ্বস্ত পরিত্যাক্ত শহর। মিত্রবাহিনী মাইকে জনগণকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন বাড়িঘরে ফিরে আসার জন্য এবং দোকানপাট বাজার খোলার জন্য- সীমান্ত শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া- যেখানে নয় মাসই প্রচন্ড যুদ্ধ হয়েছে- সব পুড়ে ছাড়খার হানাদার পাকিস্তানিরা পালানোর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বুদ্ধিজীবীসহ ব্যাপকহারে গণহত্যা চালিয়ে যায় এবং গানপাউডার দিয়ে আগুন লাগিয়ে সব ভস্মিভূত করে দিয়ে যায়।। অগনিত স্তূপীকৃত মৃতদেহ প্রত্যেকের হাত দু’টি পেছন থেকে বাঁধা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের বাণিজ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক লুৎফর রহমানের লাশও পাওয়া যায়। স্তব্ধ আতঙ্কিত বিধ্বস্ত শহর মুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবস্থা দেখে এবং পাকিস্তানিদের অত্যাচারের রেখে যাওয়া চিহ্ন দেখে হতবাক হয়ে যায় মিত্রবাহিনী এবং মিত্রবাহিনী জনগণকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলতে শুনা যায়- “ক্যায়া ভাই আদমীকো ঘর লোটনে বলো, দোকান মাকান সাজাও। খাও, পিও, গাও।” [সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আগরতলা ত্রিপুরা -সুকুমার বিশ্বাস] স্বর্গ থেকে নেমে আসা মিত্রবাহিনী যেনো মুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীকে ঘরে ফিরে আসার জন্য এভাবে আহ্বান জানাচ্ছেন- “যাঁরা স্বর্গগত তাঁরা এখনও জানেন/ স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি/ এসো স্বদেশ ব্রতের মহা দীক্ষা লভি/ সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি।”
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৫
https://www.youtube.com/watch?v=sC9PD6C66fM&feature=youtu.be
“মুক্তির মন্দির সোপানতলে/ কত প্রাণ হলো বলিদান,/ লেখা আছে অশ্রুজলে।।/ কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা,/ বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙ্গা/ তাঁরা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতে/ যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে।।/ যাঁরা স্বর্গগত তাঁরা এখনও জানেন/ স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি/ এসো স্বদেশ ব্রতের মহা দীক্ষা লভি/ সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি।/ যাঁরা জীর্ণ জাতির বুকে জাগালো আশা,/
মৌল মলিন মুখে জোগালো ভাষা/ আজি রক্ত কমলে গাঁথা মাল্যখানি/ বিজয় লক্ষ্মী দেবে তাঁদেরই গলে।।” [গানটি লিখেছেন- মোহিনী চৌধুরী এবং সুর করেছেন কৃষ্ণ চন্দ্র দে]
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৪
চট্টগামের পলায়নপর পাকিস্তান আর্মিরা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিয়েছে। অন্যদিকে পদস্থ পাকিস্তানি সামরিক অফিসার ও প্রথম শ্রেণীর দালালরা পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্য দিযে বার্মায় পালানোর চেষ্টা করছে। পাকিস্তানিদের ব্রিগেট হেডকোয়র্টার রাঙ্গামাটি পতনের পর একটি বিক্ষপ্ত অংশ আরাকানের জঙ্গল দিয়ে বার্মা পালিয়ে যায়। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের পতন এখন সময়ের ব্যাপার। মিত্রবাহিনীর নৌবহর আজ কক্সবাজারের উপর আঘাত হেনে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে অকেজো করে দিয়েছে এবং বঙ্গোপসাগরে বিদেশি জাহাজের আগমন-নির্গমের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আজ মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর বিমান বহর ৪০ বার পাকিস্তানিদের অবস্থানের উপর আক্রমন চালিয়েছে। [চলবে]
লেখক: ফারুক ওয়াহিদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা; ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।