নারীর রূপ ও শরীরের গঠন- সমাজের মাথাব্যাথা ঘুচবে কবে?
১৩ জানুয়ারি ২০১৮ ১৩:৫৬
মারজিয়া প্রভা।।
মাইক্রোবায়োলজি থেকে পাশ করে সুমনা মাত্র যোগ দিয়েছে নতুন এক কোম্পানিতে। হাসপাতালে কাজ করতে করতে এক সহকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক হলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলো বিয়ে করবে। আংটি বদলও হয়ে গেলো। এনগেজমেন্টের পরে প্রেমিকের চরিত্র বদলে গেলো। সারাক্ষণ রঙ ফর্সাকারী ক্রিম মেখে সুমনাকে ফর্সা হতে চাপ দিতে লাগল। সুমনাও ঘসে ঘসে ক্রিম মাখত চামড়া ফর্সা করার জন্য। বিয়ে ঠিক হবার ঠিক পাঁচমাস আগে সুমনা জানল, তার প্রেমিক গোপনে বিয়ে করেছে নিজের ছোটবেলার বান্ধবীকে। প্রতারণার কারণ জানতে চাইলে প্রেমিক জানায়, “সুমনা কি করে ভাবলো তার মতো দেখতে কালো একটা মেয়েকে সে বিয়ে করবে?”
ছোটবেলা থেকে মাশিয়াত তার বয়সী অন্য মেয়েদের তুলনায় উচ্চতায় খাটো। ক্লাসে প্রথম হবার পরেও টিচার তাকে এই কারণে ক্লাস ক্যাপ্টেন বানাতে চাইতেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে সমানতালে ভালো রেজাল্ট করার পরেও অনেকে তাকে “বাইট্যা” বলে হাসাহাসি করত তারই চোখের সামনে।
মোটাসোটা হবার কারণে যাবিন এই জীবনে কম কথা শোনেনি। ভারি শরীর নিয়ে রাস্তায় চলতে ফিরতেই সে শোনে “কয় মণ! কোন দোকানের চাল খায় আল্লাহর খাসি!” এইতো সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় সম্পূর্ণ অপরিচিত এক লোক তাকে দেখে বলে ওঠে, “মুটকি! খাস কি?”
নারীকে সুন্দর হতে হবে! বিউটি মিথ সৃষ্টি করে দিয়েছে নারীকে হতে হবে ফর্সা, চিকন, টানা চোখ, লম্বা চুল, মেদহীন কোমর এবং গালের অধিকারী! কি মিডিয়া, কি প্রযুক্তি, কি চিকিৎসাবিদ্যা সবকিছুই যেন প্রচার করে যাচ্ছে নারীর সৌন্দর্যের স্ট্যান্ডার্ডকে। নারী এবং পুরুষের মধ্যে শারীরিক পার্থক্য থাকলেও মূলত সমাজ এবং সংস্কৃতি ঠিক করে দিয়েছে কোন কাজগুলো নারী করতে পারবে! কোনগুলো করতে পারবে না। ঠিক এই ধারণা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে নারীকে হতে হবে সুন্দর!
নারীকে যেমন সুন্দর হতে হবে, তেমনি পুরুষকে হতে হবে অর্থক্ষম এবং পেশিশক্তিসম্পন্ন। প্রথাগত সৌন্দর্যের সংজ্ঞায় যদি কোন পুরুষের চেহারা সুন্দর হয় তবে তাকে “মেয়েলি পুরুষ” বলা হয়।
কিন্তু কেন এবং কীভাবে নির্ধারিত হলো নারীর জন্য এই সৌন্দর্য সংজ্ঞা! কবেই বা শুরু হলো নারীর রূপ নিয়ে সমাজের মাথা ব্যাথা! এই বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত জোসিয়া নিশাতের কাছে। তিনি বলেন, “নারীকে এই সেকজুয়াল অবজেক্টিফিকেশন করে দেখার শুরুটা আজ নয়। যখন থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সূচনা ঘটেছে তখন থেকে নারীকে অবজেক্ট হিসেবে দেখা হচ্ছে”।
১৯৭০ সালে ফেমিনিস্ট গ্রুপ প্রথম প্রতিবাদ জানান এই বিষয়ে। তারা বলেছিলেন যে, “শরীর” ধারণাটি যতটা না বায়োলজিক্যাল, তার চাইতেও বেশি সামাজিক অর্থনৈতিক। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত ফরাসি লেখক ও দার্শনিক সিমোন দ্য বোভেয়ার বলেছেন, “কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, ধীরে ধীরে সে নারী হয়ে উঠে!”
পুরুষতান্ত্রিকতার বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পুঁজিবাদ। এই পুঁজিবাদ সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক এই সৌন্দর্যের সংজ্ঞাকে আরো জিইয়ে রেখেছে। সারা বিশ্বে কসমেটিকস পণ্য, কসমেটিক সার্জারি রমরমা ব্যবসা করে চলছে। মূল কথা হচ্ছে পুঁজিবাদ সৌন্দর্যের এই ধারণাকে কেনাবেচা করছে। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত লেখক নাওমি উলফ তার ‘The Beauty Myth: How Images of Beauty are used against women’ বইতে বলেছেন, “দিনে দিনে eating disorder বাড়ছে। কসমেটিক সার্জারি দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে মার্কেটে, পর্ণোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রি শাসন করছে মিডিয়াকে। প্রায় ৩৩ হাজার নারী সায় দিচ্ছে, যেকোনো লক্ষ্য অর্জন করার চাইতে তারা নিজেদের শারীরিক ওজন ১০ থেকে ১২ পাউন্ড কমাতে বেশি স্বচ্ছন্দ। অনেক নারী এখন প্রচুর উপার্জন করছে, শক্তিমত্তায় কিংবা মর্যাদায় এগিয়ে আছে। কিন্তু যখনই তাদের বলা হয় তারা তাদের শরীর নিয়ে কি ভাবছে! তখনই বোঝা যায় তাদের অবস্থা তাদের অশিক্ষিত বন্দি জীবন কাটানো দাদী নানীদের চাইতেও খারাপ।’’
নাওমি উলফ এর মতে, এই যে নারীরা তাদের মুখ বা শরীরের সৌন্দর্য নিয়ে নিজেদের ভালোলাগার কথা বলছে তা মূলত তাদের শেখানো হয়েছে। দীর্ঘদিন মানসিক এবং রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত হতে হতে তারা ভাবতে শিখেছে শারীরিকভাবে সুন্দর হওয়াটাই কেবল নারীদের শক্তি! বলাই বাহুল্য, পুরুষতন্ত্র এই ধ্যানধারণার বীজ বুনে দিয়েছে নারীর মনে। তাই পুরুষতন্ত্রের ঠিক করা ‘সৌন্দর্য’ ধারণায় নারী বুঁদ হয়ে আছে।
এই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক বিদিশা হক বলেন, মিডিয়াতে কখনো কোন শিক্ষিত নারী, উদ্যোক্তা নারী কিংবা ব্যবসাসফল নারীকে রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হয় না। রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপিত হয় সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়া নারীটি। আমাদের বিভিন্ন গণমাধ্যম যেমন- নাটক, সিনেমা, উপন্যাসে বারবার নায়িকাকে রাখা হয়েছে অসম্ভব রূপবতী কোন চরিত্র হিসেবে। এইসব গণমাধ্যমে নারীর শিক্ষা কিংবা ক্ষমতায়ন কখনোই তেমন ফোকাস করা হয়না। যেসব মেয়ে প্রথাগত সৌন্দর্যের মধ্যে পড়ে না, তাদের জীবন কষ্টে জর্জরিত হয়ে যায় এমন মেসেজ বহন করে আমাদের অধিকাংশ গণমাধ্যম।
নিজের চারপাশের মানুষগুলোর অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে বিদিশা হক জানান, কোন মেয়ে যদি কর্মক্ষেত্রে উন্নতি করে তখন তার মেধা বা বুদ্ধিকে এপ্রিশিয়েট করা হয় না। বলা হয়, ‘দেখতে ভালো হওয়ার’ কারণে সে পদোন্নতি পেয়েছে। এর কারণ হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনো মানতেই পারে না নারীর বুদ্ধি বা মেধা থাকতে পারে। তাদের আরোপিত ধারণা হচ্ছে সৌন্দর্যই একজন নারীর সব!
কিভাবে পরিবর্তন হতে পারে এই দৃষ্টিভঙ্গির! এই বিষয়ে তিনি বলেন, পরিবার থেকেই জেন্ডার সেনসেটিভ এক পরিবেশে বড় করতে হবে সন্তানকে। মেয়ে সন্তান হলে তার রূপ সৌন্দর্যের উপর মনোযোগ না দিয়ে! তাকে সুন্দর হয়ে উঠতেই হবে এমন ধারণা না চাপিয়ে! তার মেধা বুদ্ধির উৎকর্ষ সাধনে কাজ করে যেতে হবে। অপরদিকে একজন ছেলেকে ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে নারী পণ্য বানানো যাবে না। নারী এবং পুরুষ সমান- এই ভাবনা থেকেই বদল ঘটবে মানসিকতার।
ছোটবেলা থেকে পাঠ্যপুস্তকে বয়সানুযায়ী সঠিক জেন্ডার সেনসেটিভ এবং যৌন শিক্ষা দেবার মাধ্যমেই এই দৃষ্টিভঙ্গি বদল করা সম্ভব। নারী যতবেশি আত্মনির্ভর এবং স্বাবলম্বী হবে এবং নিজের মেধাকে এপ্রিশিয়েট করা শিখবে, ততবেশি নারীর রূপ ও শরীরের গঠন নিয়ে সমাজের মাথা ব্যাথা কমবে। নারী কোন অবজেক্ট নয়- নিজেদের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে নারীকেই এই মিথটি ভাঙ্গতে হবে।
ছবি- ফারহানা ফারা
সারাবাংলা/এসএস
কসমেটিকস নারী পুঁজিবাদ পুরুষতান্ত্রিক ফেমিনিজম ফেমিনিস্ট সৌন্দর্য