রাজনৈতিক ধর্ষণ
৪ জানুয়ারি ২০১৯ ১৪:১৩
।। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।।
নির্বাচন হয়েছে ৩০ ডিসেম্বর। সেই থেকে আমরা একটি ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছি। সেদিন রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে কিছু দুর্বৃত্ত ৪০ বছর বয়সী এক নারী, যিনি চার সন্তানের মা, তার বসতঘর ভাঙচুর করে। এক পর্যায়ে তারা ওই নারীর স্বামী ও সন্তানকে বেঁধে রেখে তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে গণধর্ষণ ও পিটিয়ে আহত করে। পরদিন ওই নারী ও তার স্বামীকে ২৫০ শয্যার নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বামী ৯ জনকে আসামি করে চরজব্বার থানায় মামলা দায়ের করেন। অভিযোগ উঠেছে, ধর্ষকরা সবাই সরকার দলীয় কর্মী-সমর্থক এবং এই নারীর পরিবারটি নির্বাচনে ধানের শীষে ভোট দেওয়ায় এমন বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
২০০১-এর নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জেতার পর রাত থেকেই মাসব্যাপী ধর্ষণের উৎসব চলছিল। হিন্দু মেয়েরা ছিল রাজনৈতিকভাবে উৎসাহিত সেই গণধর্ষণের প্রধান শিকার। এছাড়া ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করে— এমন পরিবারের নারীরাও নির্যাতিত হয়েছিল। তৎকালীন সরকার কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ব্যাপক লেখালেখির পরও। নোয়াখালীর ঘটনা বলে দিলো, আমাদের ভোট-রাজনীতি বদলাতে চায় না। আমাদের আশঙ্কা, আজ যেটা নোয়াখালীতে ঘটলো, কাল সেটা আরেক জেলায় ঘটতে পারে। যেকোনো জায়গাতেই এমনটা হতে পারে। আশার কথা এই, সরকারের নির্দেশে পুলিশ নোয়াখালীর ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে এবং আসামিরা গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু দুঃখ পেতে হয় এ কারণে, কোনো রাজনীতির জনপ্রিয় নেতা গিয়ে সেই পরিবারটির পাশে এখনও দাঁড়ালেন না।
একটি বা একাধিক, কোনো বিতর্ক হতে পারে না। চাওয়া একটাই, আর তা হলো একটা ঘটনাও যেন না ঘটে। রাজনৈতিক ধর্ষণের পর হয়তো সংখ্যা নিয়ে তর্ক করতে চাইবে অনেকে। কিন্তু ধর্ষণসহ নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে। না হলে বোঝা যাবে না, ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে সরকার উদ্যোগী কি না। আমাদের খুব গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে, রাজনীতিতে কেন এত খামতি, যা মেয়েদের বিপদ বাড়ায়?
দেশ এগিয়েছে, উন্নতি করেছে, মেয়েরাও বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে বড় কারণের একটি উৎপাদনশীলতায় নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ। তবু মেয়েদের ওপর অপরাধ বাড়ছে। হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে আগের চেয়ে অনেক ঘটনা দ্রুত জানা যাচ্ছে, নারীরা আগের চেয়ে বেশি করে থানায় অভিযোগ দায়ের করছে। নারীরা আগের চেয়ে স্বাধীনতা ও মর্যাদা সচেতন হওয়ায় ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হচ্ছে বেশি করে।
যে রাজনীতি ধর্ষণের সংখ্যা দিয়ে ধর্ষণের গুরুত্ব বিচার করে, যে রাজনীতি ধর্ষণকারীর প্রতি যত না অসহিষ্ণু, তার চেয়ে ঢের বেশি অসহিষ্ণু ধর্ষণের শিকার যে নারী, তার প্রতি; এই বহু দিনের চেনা রাজনীতির সমস্যা হলো ক্ষমতার বণ্টন। ভালো রাজনীতি মানুষে-মানুষে ক্ষমতায় সমতা আনে। খারাপ রাজনীতি বৈষম্য তৈরি করে, বৈষম্য বজায় রাখে। মেয়েদের সক্ষমতা, মেয়েদের আত্মবিশ্বাস কেড়ে নেওয়ার সবচেয়ে সহজ যে উপায় পুরুষদের হাতে রয়েছে, তা হলো যৌন হিংসা।
একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হলে তার বার্তা যায় অসংখ্য মেয়ের কাছে। এই ধর্ষকদের মানসিকতা এমন যে তারা বারবার বুঝিয়ে দেয়, ‘মেয়েরা এগিয়ে যেতে পারে, অনেক এগিয়ে যেতে পারে লেখাপড়ায়, এমনকি রাজনীতিতে। কিন্তু ছেলেরা ধর্ষণ করতে পারে।’
ক্ষমতার রাজনীতির দুর্বিনীত শক্তির বার্তা নোয়াখালীর ধর্ষণ। এর সংখ্যা একটি, কিন্তু এর একটি তীব্র বার্তা আছে। এই পরিবারটির মতো আরও অসংখ্য পরিবার নির্ঘুম রাত কাটাবে, ভয়ে কাতর থাকবে। রাজনীতি যে রাষ্ট্রের মোকাবিলা করে মেয়েদের ক্ষমতা বাড়াতে পারে, সেই সম্ভাবনাই নষ্ট করতে চায় ধর্ষকরা। এদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলে রাষ্ট্রক্ষমতায় নারীবিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে। ক্ষমতা কাঠামোর সুযোগ নিয়ে ধর্ষকরা বারবার নির্যাতনের জমি তৈরি করে, সময়-সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, কখন তারা আবার ধর্ষণ করতে পারবে।
দেশকে ধর্ষণমুক্ত করতে গেলে সরকারকে প্রচুর কাজ করতে হয়। যারা বলছেন, ক্রসফায়ার করা দরকার, তারা ভুল জায়গায় আছেন। এর চেয়ে সহজ কাজ আর কিছু নেই। জনগণও খুশি হয়। তখনকার মতো সব সমস্যাকে চমৎকার ধামাচাপা দেওয়া যায়। যে কাজগুলো করলে সমাজের সত্যিকার ভালো হয়, সে কাজগুলোর দাবি করা দরকার। সমাজকে সবার জন্য নিরাপদ করতে গেলে রাজনীতিতে গণ্ডায় গণ্ডায় গুণ্ডা পোষা বন্ধ করতে হবে।
ধর্ষণের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে আরও কিছু কাজ করা সম্ভব। একবার ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে রাষ্ট্রীয় কোন কোন সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা যায়, তা ভাবা যেতে পারে। যেমন— পাসপোর্ট দেওয়া হবে না বা থাকলে তা কেড়ে নেওয়া হবে, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে ধরনের পুলিশি ক্লিয়ারেন্স লাগে, সেটা আটকে দেওয়া হবে। এসব শাস্তির একটা সামাজিক গুরুত্ব আছে।
আইন, আদালত, পুলিশ ক্ষমতাবানদের জন্য। দরিদ্র, অসহায়দের জন্য তাদের ভূমিকা রক্ষকের চেয়ে বেশি ভক্ষকের। আর তারা যদি মেয়ে হয়, তা হলে তো কথাই নেই। এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে সমাজকেই এবং নানা স্তরে। শাস্তি দিয়ে অপরাধের পথে একটা বাধা তৈরি করা যায় নিশ্চয়ই, কিন্তু সামাজিক সংবেদনশীলতা বাড়ানোর কাজটাই জরুরি। প্রতিটি পরিবার থেকে এই সংবেদনশীলতা তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। আমাদের ঘরের ছেলেদের বলতে হবে যে, আমাদের মেয়েরাও তাদের সমান, তাদের থেকে কোনো অংশে কম নয়।
লেখক: এডিটর ইন চিফ সারাবাংলা ডটনেট, দৈনিক সারাবাংলা ও জিটিভি
সারাবাংলা/আরএফ
আইন আদালত রাজনৈতিক অচলাবস্থা সারাবাংলা সারাবাংলা ডট নেট সুবর্ণচর সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা